আযানের সাথে সাথেই আজ ছেলেকে নিয়ে এশার সালাতে উপস্থিত হয়ে প্রথম কাতারের এক পার্শ্বে অবস্থান করেছিলাম। সালাত শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট পূর্বে মাওলানা আব্দুল খালেক এর “আসমানী আযাব কেন”? বইটি দেখে কৌতুহল জাগলো। ছোট্ট চটি আকারের এই বইটি বাংলাদেশে ইসলামিক সেন্টার থেকে মূদ্রিত হয়েছে । পুরানো ছেড়াফাটা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনার প্রতি আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হওয়ায় সাথে সাথে মোবাইলে ছবি তুলে নিলাম, সালাত শেষে নিরিবিলি এই বিষয় নিয়ে ভাবার জন্য এবং দু-একটি তাফসীর দেখে পুরো আলোচনা অনুধাবন করার জন্য যা নিম্মে পাঠকদের সাথে শেয়ার করছি।
হযরত শুয়াইব আ. এর জাতির অধিকাংশই ছিল ব্যবসায়ী । তারা ক্রয় করার সময় অপর পক্ষকে ঠকিয়ে ওজনে বেশী মাল নেয়া এবং বিক্রীর সময় খরিদ্দারকে ওজনে কম দেয়ায় পারদর্শী ছিল। তাঁর জাতির লোকেরা সাধারণত মাপে কম দিতো এবং মানুষকে ঠকাতো। অর্থাৎ লেনদেনের সময় মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে কম দেয়া এদের নেশা ও পেশায় পরিণত হয়েছিলো।
এ এমন এক জঘন্য খাসালাত ও রোগ ছিল , যা অন্তরের পরিচ্ছন্নতা এবং বাস্তব লেনদেন উভয়টাকেই দলিত মথিত করে দেয়, যেমন করে নষ্ট করে মানুষের প্রতি সৌজন্যবোধ এবং ভদ্রতা জ্ঞানকে।
এ যালেম জাতি বাস করতো এমন সুবিধাজনক এলাকায় যে, সেখান থেকে আরব উপদ্বীপের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে গমনকারী বানিজ্য কাফেলাগুলোকে অতিক্রম করতেই হতো। অর্থাৎ সকল এলাকার বাণিজ্য যাত্রীদের এটাই ছিলো যাতায়াতের একমাত্র পথ। এ সুযোগে তাদের ওপর এ এলাকাবাসী প্রাধান্য বিস্তার করতো এবং জবরদস্তী করে তাদেরকে বাধ্য করতো ওদের শর্তেেই লেনদেন করতে।
উপরোক্ত চিত্রটি কী আমাদের নিকট স্পষ্ট হচ্ছে না? বর্তমানেও আমরা দেখছি যে, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে জনগনকে কষ্টে ফেলছে।
আল্লাহর নবী উপরোক্ত রোগ থেকে মু্ক্ত করতে তাদেরকে ওসব নিকৃষ্ট কাজগুলো পরিত্যাগ করার আহ্বান জানান। হযরত শুয়াইব আ. তার জাতির মধ্যে নৈতিক রোগ দূর করার লক্ষ্যে তাদের ডেকে বলছিলেন,
“ আর হে আমার সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা! যথাযথ ইনসাফ সহকারে মাপো ও ওজন করো এবং লোকদেরকে তাদের প্রাপ্য সামগ্রী কম দিয়ো না। আর পৃথিবীতে বিপর্যয় ছড়িয়ে বেড়িয়ো না।(হুদ- ৮৫)”
কিন্তু তাঁর গুমরাহ জাতি, তাঁকে এর জবাবে উত্তর দিয়েছিলো,
“হে শো’আয়েব! তোমার অনেক কথাই তো আমরা বুঝতে পারি না(*১) আর আমরা দেখছি তুমি আমাদের মধ্যে একজন দুর্বল ব্যক্তি। তোমার ভ্রাতৃগোষ্ঠী না থাকলে আমরা কবেই তোমাকে পাথর নিক্ষেপে মেরে ফেলতাম। আমাদের ওপর প্রবল হবার মতো ক্ষমতা তোমার নেই(*২)। (সূরা হুদ-৯১)”
শুয়াইব আ. এর জাতির অন্তর এতটাই পাথর হয়ে গিয়েছিল যে, তারা বুঝতেই পারতো না যে, ব্যবসা বানিজ্যে একটু হাত সাফাই না করলে ব্যবসা কী করে চলতে পারে। তারা মনে করতো ওটাও ব্যবসায়ের একটা দক্ষতা। তাই ওসব পরিত্যাগ করার অর্থ হল ব্যবসায়ে মুনাফার পরিমাণ কমে যাওয়া। এজন্য তারা আল্লাহর নবীকে বলতো যে, তাঁর কথাবার্তা উদ্ভট মনে করছে এবং এসব নীতি বাক্য উচ্চারণ ও প্রতিপালনের ফলেই হযরত শুয়াইব আ. অর্থনৈতিক দিক থেকে দরিদ্র ও দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর স্বগোত্রীয়দের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ছিলে বিধায় তাঁর উপর আক্রমন করতে সাহস করেনি। অন্যথায় তারা সদুপদেশ দেওয়ার প্রতিদানে আল্লাহর নবীকে পাথর মেরে হত্যা করতেও প্রস্তুত ছিল।
অথচ হযরত শো’আয়েব কোন বিদেশী ভাষায় কথা বলছিলেন না। অথবা তাঁর কথা কঠিন, সূক্ষ্ম বা জটিলও ছিল না। কথা সবই সোজা ও পরিষ্কার ছিল। সেখানকার প্রচলিত ভাষায়ই কথা বলা হতো। কিন্তু তাদের মানসিক কাঠামো এত বেশী বেঁকে গিয়েছিল যে, হযরত শো’য়েব আ. এর সোজা সরল কথাবার্তা তার মধ্যে কোন প্রকারেই প্রবেশ করতে পারতো না।
একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, যারা অন্ধপ্রীতি, বিদ্বেষ ও গোষ্ঠী স্বার্থ দোষে দুষ্ট হয় এবং প্রবৃত্তির লালসার পূজা করার ক্ষেত্রে একগুঁয়েমির নীতি অবলম্বন করে, আবার এ সঙ্গে কোন বিশেষ চিন্তাধারার ওপর অনড় হয়ে বসে থাকে তারা তো প্রথমত এমন কোন কথা শুনতেই পারে না যা তাদের চিন্তাধারা থেকে ভিন্নতর আর যদি কখনো শুনেই নিয়ে থাকে তাহলে তারা বুঝতেই পারে না যে, এসব আবার কেমন ধারার কথা!
আবার এই বিষয়গুলো অধ্যয়ণ করার সময় একথা অবশ্যি সামনে থাকা দরকার যে, এ আয়াতগুলো যখন নাযিল হয় তখন হুবহু একই রকম অবস্থা মক্কাতেও বিরাজ করছিল। সে সময় কুরাইশরাও একইভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রক্ত পিপাসু হয়ে উঠেছিল। তারা তাঁর জীবননাশ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু শুধু বনী হাশেম তাঁর পেছনে ছিল বলেই তাঁর গায়ে হাত দিতে ভয় পাচ্ছিল। কাজেই হযরত শো’য়েব আ. ও তাঁর জাতির এ ঘটনাকে যথাযথভাবে কুরাইশ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
এই রোগ থেকে মুক্তির উপায় কী?
লেনদেনের সময় মানুষকে ঠকানো ও কষ্ট দেয়ার এ দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা হতে পারে একমাত্র আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার ওপর অবিচল বিশ্বাসের ওপর। তাঁর যাবতীয় হুকুম পালনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে বাস্তব আনুগত্য, আমানতের হক আদায়ের অনুভূতি, লেনদেনের পরিচ্ছন্নতা, ব্যবসায়ী সততা ও লোকদের সাথে ভদ্রতাপূর্ণ আচরণ। ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের সাথে লেনদেন কালে একমাত্র আল্লাহভীতিই তাদের গোপন চুক্তিকে ঠেকাতে পারে। এ পরিত্র ঈমানই মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী বানানোর গ্যারান্টি দেয়, নিশ্চয়তা বিধান করে পৃথিবীর মানুষের মধ্যে সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার।
অবশ্যই সুষ্ঠু লেনদেন ও চারিত্রিক বলিষ্ঠতার পেছনে কোন মযবুত ভিত্তি থাকতে হবে, যা নিত্য পরিবর্তনশীল কোন মনমানসিকতার সাথে জড়িত নয়, আর তা হচ্ছে ইসলাম। আর পূর্ণাঙ্গ এ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বুনিয়াদীভাবে মানব নির্মিত যে কোন সামাজিক ও নৈতিক ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষের চিন্তা-প্রসূত ও মনগড়া ধারণা, অনুমানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ব্যবস্থায় তাদের বাহ্যিক সুযোগ সুবিধার দিকেই খেয়াল দেওয়া হয় মাত্র!
আর যখন ইসলামের স্থায়ী ভিত্তির ওপর কোন নীতি নৈতিকতা গড়ে ওঠে, তখন সেখানে (সাময়িক ও ) উপস্থিত সুযোগ সুবিধা ও বস্তুগত স্বার্থ গৌণ হয়ে যায় এব ইসলামী অনুভূতি ও আল্লাহর ভয়ের প্রভাবে গোটা পরিবেশের মধ্যে দেখা দেয় অভাবনীয় পরিবর্তন। মানুষ কৃষি ক্ষেত্রে কাজ করুক, পশু চড়াক, বা শিল্প কারখানার মধ্যে যেখানেই যখন কাজ করুক না কেন, আল্লাহর ভয় এবং তাঁর কাছে জওয়াবদিহি করার চিন্তা না থাকলে তাদের লেনদেন কোন স্থায়ী নীতি নৈতিকার দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পাদিত হওয়া সম্ভব না।
যখন জীবনের সকল বিষয়কে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করা হবে এবং সকল কাজের পেছনে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা করবে, তাঁর কাছেই প্রতিদান পাওয়া আকাংখা করবে এবং তাঁর আযাব থেকে বাঁচার প্রেরণা কাজ করবে তখন মানুষে মানুষে গড়ে উঠবে পারস্পরিক সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
আর নীতি নৈতিকতা সম্পর্কিত মানুষের তৈরী বিভিন্ন মতবাদের যতোই প্রশংসা করা হোক না কেন, বাস্তব জীবনে ইসলামী নৈতিকার মোকাবেলায় অর্থনৈতিক আদান প্রদান ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সে সব ব্যর্থ ও নিষ্ফল বলে প্রমানিত হবে।
তথ্য সহায়তা: তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন ও তাফহীমুল কুরআন এর সূরা হুদ থেকে।
তারিখ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২