ক্যাটাগরিসমূহ
বিষয় ভিত্তিক আলোচনা

একজন কবির দৃষ্টিতে তারুণ্য সম্পর্কিত কিছু কথা মালা।

সৌন্দর্যের অভাব মানেই অজ্ঞানতা। অজ্ঞানতাই অপসংস্কৃতির জন্ম দেয়। সংস্কৃতির অভাব অথবা অপসংস্কৃতি দুটোই যে কোন জাতিকে নিঃশেষ করে দেয়। সংস্কৃতির অভাব থেকেই অবিচারের জন্ম হয়। অবিচার থেকেই শুরু হয় নৈরাজ্য। যেখানে নৈরাজ্য থাকে সেখানে কোন কিছুতেই সুস্থতা আশা করা যায় না। আর অসুস্থতা যে কোনো জাতির জন্যই ধ্বংসের কারণ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।

তারুণ্য মানে কম বয়সের কেউ শুধু তা নয়। কিংবা তরতাজা শরীরের অধিকারী তাও নয়। তারুণ্যতো মনেরই ব্যপার। মনের গহিন থেকে তারুণ্যের উদ্ভাস উচ্চতিক হয়। একজন বৃদ্ধও তারূণ্যের শক্তিতে বলীয়ান হতে পারেন। পারে নতুন নির্মাণের প্রতিনিধি হতে। তারুণ্যের জয় চিরদিন। চির সুন্দরের প্রতিনিধি তারা। তারা জাগ্রত চিত্তের সৈনিক।

বিদ্রোহ মানেই ঔদ্ধত্য নয়। বিদ্রোহ মানে নয় সীমা লংঘন করা।যারা ঔদ্ধত্য যারা সীমা লংঘনকারী এবং যারা বেয়াদব তারাতো সৃষ্টিশীলতার শালীনতা অতিক্রম করে। আর অশালীন বিষয়তো শিল্প হতে পারে না। এটাই তারুণ্যের বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তিতে ডুবে গেলে তার কোন রক্ষা নেই। তার সম্ভাবনা রহিত হয়ে যায়। সে পুড়ে যায় বিভ্রান্তির অনলে।পৃথিবীর কোন বিদ্রোাহই শ্লীল বিষয়ের প্রতি অশ্লীল হতে শেখায়নি। কোন বিদ্রোহই ঐতিহ্যকে মথিত করেনি। তারুণ্যের বিদ্রোহও তা করে না। যদি করা হয় তাকে বিদ্রোহ বলা যায় না। তাকে বলতে হবে অসদাচরণ। কিংবা মূর্খের অহংকার। এ অহংকারই তারুণ্যের বিভ্রান্তি। মূর্খের অহংকার বড়ই বেমানান। বড় অসুন্দর। এমন অসুন্দর তারুণ্যের ধর্ম হতে পারে না।

যারা জানে শিক্ষার মর্ম কি এবং জানে কবিতার ইতিহাস ঐতিহ্য তারা অগ্রজের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে উচ্চকণ্ঠ। তারা কোন ভাবেই হীনমন্যতায় ভোগে না। তারা নির্মাণ করে সীমানার নতুন প্রাচীর। নির্মাণ করে নতুন ধারা আনন্দ। তারা চেনে বিদ্রোহ আর বিভ্রান্তির দাগ। তারা বিদ্রোহী সুন্দরের পক্ষে। তারা বিদ্রোহী নুতন সৃষ্টির লক্ষে। মূর্খের অহংকার থেকে তারা মুক্ত। তারা বিদ্রোহকে কখনো বিভ্রান্তির চোরা বালিতে ডোবায় না। তারা জানে তারুণ্য দ্বীধাহীন। কিন্তু অজ্ঞানতার ঔদ্ধত্য তাদের টলায় না। তারা মুক্তির আনন্দে বিভোর এক নতুন পৃথিবীর উদ্গতা।

কথাগুলোর কোন মিল আমাদের মধ্যে খুঁজে পাই কিনা ?

তথ্যসূত্র: প্রবন্ধ “তারুণ্যের বিদ্রোহ ও বিভ্রান্তি”- জাকির আবু জাফর, শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির কাগজ নতুন এক মাত্রা, হেমন্ত সংখ্যা, নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০২০।

ক্যাটাগরিসমূহ
বই রিভিউ

মুসলিম চরিত্র

ইসলাম এমন একটি জীবন দর্শন, যার অন্যতম ভিত্তি হলো দান, সাদাকা, উদারতা ও মানবকল্যাণ। সংকীর্ণতা, লোভ এবং কৃপণতা হলো এমন বাজে বৈশিষ্ট্য, যা ইসলামের এসব ভিত্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইসলামের আকাঙ্ক্ষা- এর অনুসারীরা সব সময় উদার হবে, বেশি বেশি করে ক্ষমার চর্চা করবে। ইসলাম সব সময়ই বলে মানুষের সাথে সদ্বব্যহার করার জন্য, যারা সৎকর্মশীল তাদের সহযোগিতা করার জন্য এবং সব ধরনের ভালো ও ন্যায়নিষ্ঠ কাজ করার জন্য। সৎভাবে জীবনযাপন করাকেই তাই মুসলমানদের একমাত্র স্থায়ী নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

পুরো বইটি আলোচনা করা হয়েছে চরিত্র নিয়ে। মানুষের চরিত্র নিয়ে। মুসলমানদের চরিত্র নিয়ে।

ছোট সময় থেকেই জেনে আসছি শুনে আসছি সেই সর্বোত্তম ব্যক্তি যার চরিত্র সর্বোত্তম। কিন্তু এই চরিত্রের মানদন্ড আসলে কী?

যে বা যারা চোর, ডাকাত, লুন্ঠনকারী, ঘুষখোর, সুদখোর, সমকামী তারাতো তাদের সমভাবাপন্ন লোকদেরকেই বন্ধু বা দায়িত্বশীল হিসেবে পেতে চাইবে।

সৎ পুলিশ, সৎ বিচারক, সৎ প্রশাসক, সৎ শাসক, সৎ আলেম যারা কোন প্রকার অন্যায় প্রশয় দিতে চায় না, তাদের কে এরা নিকৃষ্টতম হিসেবে গন্য করে বা ঘৃণা করে  তাদের অন্যায় ও সমাজ ধ্বংসকারী কাজে বাধা প্রদানের জন্য।

আবার যারা চুরি করে না, লুন্ঠন করে না সকলকে সম্মান করে তাদের কাছে এ্ই সৎ চরিত্রের লোকগুলো প্রিয়পাত্র হয়ে থাকে, এর বিপরীত টাইপের লোকদের নিকৃষ্ট মনে করে। তাহলে এই যদি হয় অবস্থা কীভাবে আমি বা আমরা চরিত্রের মানদন্ড দাড় করাবো।

মুসলিম হিসেবে চারিত্রিক মানদন্ডতো আমাদের তাই হওয়া উচিত যা আল্লাহতায়ালা রাসূলূল্লাহ সা. এর মাধ্যমে আমাদের হাতে কলমে শিক্ষা দিয়েছেন। আমাদের চরিত্র কেমন হবে তা কুরআনে পাতায়, হাদিসের শিক্ষায় ও ইসলামী ইতিহাসের আলোচনায় স্পষ্টভাবেই উল্লিখিত করা আছে, যে মুসলিম হতে হলে তাকে অবশ্যই কিছু মৌলিক গুন বা চরিত্র অর্জন করতে হবে অন্যথায় সে প্রকৃত মুসলিম হতে পারবে না।

অথচ আমাদের সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখি সাধারণ শিক্ষিত সচেতন ডিগ্রিধারী লোকগুলো সকল প্রকার অন্যায় কাজে জড়িত হয়ে পড়ছে আবার চারিত্রিক সনদপত্র পাচ্ছে শুধু তা কেন আমাদের কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উপরোক্ত অন্যায় ও ঘৃণীত কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারছে না যদিও তাদের চারিত্রিক কাগুজে সনদ খুবেই ভারি।

সত্য কথা বলা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, আমানত রক্ষা করা, ইয়াতিমদের দেখাশোনা করা, গীবত না করা, অর্থ দান করা, যাকাত প্রদান করা, সুদ বন্ধ করা, সকল প্রকার যিনার কার্যক্রম থেকে দুরে রাখা ও দুরে থাকা, সৎ কাজের আদেশ করা, অসৎ কাজে বাধা প্রদান করা ইত্যাদি যে গুরুত্বপূর্ণ গুনাবলি মুসলমানদের মধ্যে থাকার কথা ছিল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে  তার ঘাটতি থাকার কারনে মুসলমানরা আজ দুনিয়াতে অপদস্তমূলক জীবনযাপন করছে যা থেকে উত্তরণ করতে হলে আমাদের এই গুণগুলো শুধু ব্যক্তিগত নয় ও রাস্ট্রীয়ভাবেই অর্জন করতে হবে।

বইটি থেকে কিছু আলোচনা পাঠকদের কাছে শেয়ার করছি যাতে নিজেকে এবং শুভাকাঙ্খিদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য, যে প্রকৃত মুসলিমের কী কী চারিত্রিক গুনাবলী অর্জণ করতে হয়। পোষ্টটি বড় হলেও আশাকরি এই আলোচনাটি পাঠের মাধ্যমে সকলে তাদের হৃদয় গহীনের প্রকৃত চেহারা স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে এবং, নিজেদের সংশোধন করতে উৎসাহিত হবে যেমনটি আমি উৎসাহিত ও সতর্ক হয়েছি।

হজরত হুসাইন থেকে বর্ণিত। রাসূল ﷺ বলেছেন-

‘যখন আল্লাহ একটি জাতির সাথে সহানুভূতিশীল আচরণ করতে চান, তখন তিনি সেই জাতির শাসনভার জ্ঞানীদের হাতে অর্পণ করেন, সম্পদগুলোকে উদার লোকদের হাতে ছেড়ে দেন। আর যখন তিনি কোনো জাতিকে শাস্তি দিতে চান, তখন তিনি তার শাসনভার বোকা ও নির্বোধদের হাতে অর্পণ করেন। আর সম্পদগুলোকে কৃপণ ব্যক্তিদের হাতে ছেড়ে দেন।’ আত তারগিব : ৩৯৫০

মূল লেখক চরিত্র  প্রসঙ্গে একটি হাদিসে কুদসি উল্লেখ করেছেন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-

‘আমি কেবল তারই ইবাদাত কবুল করি, যে নম্রতার চর্চা করে, আমার প্রতি শোকরগুজারি হয়। আমার প্রতিটি সৃষ্টি আর প্রতিটি নিয়ামতকে মূল্যায়ন করে, আমার বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় না, সারাটা দিন আমার স্মরণেই কাটায় এবং গরিব-দুঃখী, মুসাফির, মজলুম এবং অবহেলিত মানুষদের প্রতি দয়া করে।’

যদি ইবাদাতগুলো কোনো মানুষের অন্তরকে বিশুদ্ধ করতে না পারে, যদি এ ইবাদাতগুলো মানুষের ভেতরকার উত্তম বৈশিষ্ট্যগুলো বের করে আনতে না পারে, কিংবা এ ইবাদাতগুলো পালন করার পরও যদি আল্লাহর সাথে তাঁর বান্দার সম্পর্কটি সুদৃঢ় না হয়, তাহলে সেই হতভাগা ব্যক্তির জন্য ধ্বংস ও বিপর্যয় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

একটিমাত্র উপায়ে সালাত পড়লে বা ইবাদাত পালন করলেই কেবল প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হবে- যদি ইবাদাতকারী উৎকৃষ্ট নৈতিকতা ধারণ করতে পারেন। যার নৈতিকতা উন্নত হবে, তার ইবাদাতও উপকারে আসবে। কিন্তু কারও নৈতিকতায় যদি দুর্বলতা থাকে, তাহলে তার ইবাদাতও কোনো কাজে আসবে না।

ঈমান : একটি বৈপ্লবিক ও উদ্দীপক শক্তি

সত্যিকারের ঈমান আর দৃঢ় চেতনা এমন একটি বসন্তের মতো- যা কখনো ফুরোয় না। যেখান থেকে নিয়মিতভাবে কর্মশক্তি ও উদ্দীপনা লাভ করা যায়। যেকোনো বিপদ ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার সাহস পাওয়া যায় এবং দুঃসময়ে ধৈর্য ধারণ করার মনোবল অর্জন করা যায়। এটা মানুষের ভেতরে এক ধরনের বিরামহীন অনুভূতি তৈরি করে এবং তাকে তার আদর্শের সাথে সংযুক্ত করে দেয়- মৃত্যু এলে সে ভয় পায় না এবং একনিষ্ঠভাবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলো পালন করে যায়।

রাসূল ﷺ বলেছেন-

‘তোমরা সব ধরনের ব্যক্তির সাথে একইভাবে চলা থেকে বিরত হও। যদি চলার পথের সেই ব্যক্তি ভালো কাজ করে, তাহলে তুমিও ভালো কাজই করবে। যদি সে খারাপ কাজ করে, তাহলে তুমিও খারাপ কাজ করবে- এমনটি যেন না হয়। বরং তোমরা তোমাদের এমনভাবে তৈরি করবে, যেন নিজেদের শুধুই সৎকর্মশীলদের সহযোগিতা করতে পারো এবং অসৎকর্মশীলদের থেকে দূরে থাকতে পারো।’ তিরমিজি

হজরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত। রাসূল ﷺ বলেছেন-

‘যে ব্যক্তি অন্যকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে, আল্লাহ তায়ালা তার ওপর অসন্তুষ্ট হন। শুধু তাই নয়, যাদের খুশি করার জন্য সে এত চেষ্টা চালায়, তারাও একসময় সেই ব্যক্তির ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন। পক্ষান্তরে যে মানুষটি অন্য লোকদের অখুশি করে হলেও আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে, আল্লাহও তার ওপর সন্তুষ্ট হন এবং তার ওপর এতটাই নিয়ামত বর্ষণ করেন যে, যেসব ব্যক্তিকে ওই লোক অখুশি করেছিলেন, তাদের কাছেও তার গ্রহণযোগ্যতা চূড়ান্তভাবে অনেকটাই বেড়ে যায়।’

তাবরানি : ১১৬৯৬।

একজন মুসলমানের উচিত হলো সে যে বিষয়টিকে সত্য মনে করে, তার ওপর অটল থাকা। আর অটল থাকতে গিয়ে যত ধরনের সমালোচনা, অপমান, উপহাস বা সংকট আসবে, বলিষ্ঠভাবে তার মোকাবিলা করা। সে তার জন্য এমন একটি নীতিমালা প্রয়োগ করবে, যার মাধ্যমে সে সর্বাবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব পাওয়ার চেষ্টা করবে। যদি কুসংস্কারচ্ছন্ন এবং অযৌক্তিক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকা লোকেরা ঈমানদার ব্যক্তিকে নিয়ে পরিহাস করে, তাহলে একজন মুমিনের উচিত দৃঢ় হওয়া এবং তার বিশ্বাসের ওপর মজবুতভাবে টিকে থাকা।

হজরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত। একদিন তিনি একটি পাহাড়ে রাসূলের সাথে বসেছিলেন। রাসূল ﷺ তাকে বললেন, হে ইবনে আব্বাস, সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করবে। তিনিই তাহলে তোমার যত্ন নেবেন। তুমি আল্লাহকে স্মরণ করলে তাঁকে সব জায়গাতেই খুঁজে পাবে। তোমার উন্নতিতে তাঁর নিয়ামতকে স্বীকার করো, তাহলে তিনি প্রতিকূলতায় তোমাকে রক্ষা করবেন। যদি তোমার কিছু চাইতেই হয়, তাহলে আল্লাহর কাছে চাও। যদি তোমার কোনো সাহায্য লাগে, তাহলে আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাও। কারণ, সকল মানুষ চাইলেও তোমাকে সাহায্য করতে পারবে না; যদি না আল্লাহ তোমার জন্য তা নির্ধারণ করে রাখেন। আর যদি সকল মানুষ মিলেও তোমার ক্ষতি করতে চায়, তাহলেও তারা পারবে না; যদি না আল্লাহ তোমার জন্য এ ধরনের কোনো ফায়সালা করেন।’

রাসূল ﷺ বলেছেন-

‘একজন দৃঢ় মুমিন সব সময়ই একজন দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম। আল্লাহও দৃঢ়চেতা মুমিনকে বেশি পছন্দ করেন। তোমরা লাভজনক বিষয় প্রত্যাশা করো, আল্লাহর সাহায্য চাও এবং বিনয়ী হও। যদি তোমার কখনো ক্ষতি হয় তাহলে বলো না যে, ওভাবে কাজটা করিনি বলে এই ক্ষতিটি হলো; বরং বলো, আল্লাহই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। তিনি যা চান তাই সিদ্ধান্ত নেন। “কিন্তু” আর “যদি” হলো এমন দুই চিন্তাধারা, যা শয়তানের কর্মকৌশলের পথ খুলে দেয়।’ মুসলিম

ভালো আচরণ ও উত্তম চরিত্র:

যে মানুষটি অসৎ, যার আচরণ ভালো নয় এবং যে কারও ক্ষতির তোয়াক্কা না করে খারাপ কাজ করতেই থাকে, তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন-

‘নম্রতা আর ঈমান একে অপরের পরিপূরক। একটি খোয়া গেলে অপরটি এমনিতেই হারিয়ে যায়।’ আল-আদাবুল মুফরাদ : ১৩১২

‘হজরত আনাস থেকে বর্ণিত। রাসূল ﷺ বলেছেন, আল্লাহর একজন বান্দা ইবাদাত পালনের ক্ষেত্রে কিছুটা কমতি থাকার পরও শুধু তার উত্তম চরিত্রের কারণেও আখিরাতে উচ্চ মর্যাদা লাভ করতে পারেন। কিন্তু চরিত্র যদি খারাপ হয়, তাহলে তাকে জাহান্নামের নিচু স্তরে ছুড়ে ফেলা হবে।’ তাবরানি : ৭৫৪

ইসলাম বেশ কিছু ইবাদাতকে বাধ্যতামূলক করেছে, যেগুলো মানুষকে শয়তানের পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আর এসব ইবাদাত কখনোই সঠিকভাবে আমল করা সম্ভব নয় কিংবা ইবাদতের মূল লক্ষ্য কখনোই অর্জন করা সম্ভব নয়; যদি না ইবাদাতকারী ব্যক্তি উত্তম চরিত্রের অধিকারী হন।

যেখানে অপরাধী ব্যক্তি নিষ্ঠুরভাবে সমাজের ন্যায্যতা ও ভারসাম্যকে অনৈতিকভাবে নষ্ট করেন, সেখানে কোন যুক্তিতে তার ব্যাপারে করুণা দেখানো হবে?

উত্তম চরিত্রের উদাহরণ হলো একটি পাকা ফলের মতো- যাকে সব ধরনের রোগ ও সংক্রামক ভাইরাস থেকে মুক্ত রাখতে হয়। তা নাহলে ফলের মিষ্টভাব ও পরিচ্ছন্নতা ধরে রাখা যায় না। আর এ কারণেই ইসলাম সব সময় কোনো ভালো কাজের মধ্যে লোক দেখানো মানসিকতা, প্রতারণা বা ভণ্ডামিকে প্রত্যাখান করেছে। প্রকৃত সত্য হলো, প্রতারণা সব ভালো কাজকে ধ্বংস করে দেয়; যেমনটা পোকামাকড় অনেক কিছুকে খেয়ে ফেলে। যখন কোনো মানুষের ভেতরে ভণ্ডামি বা প্রতারণা একেবারে গেঁথে বসে, তখন এটা এক ধরনের শিরকের পর্যায়ে মানুষকে নিয়ে যায়; যার একমাত্র পরিণতি হলো জাহান্নাম।

দান করার গুরুত্ব:

‘দান বা সাদাকা গুনাহ মিটিয়ে ফেলে, যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে।’ সহিহুল জামে : ৫১৩৬

কাউকে কিছু দান করার গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন-

‘কারও মুখে হাসি ফোটানো সাদাকা। ভালো কাজ করা এবং অন্যকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখাও সাদাকা। রাস্তায় অন্য কোনো পথচারীর সমস্যা হতে পারে এ আশঙ্কায় সড়ক থেকে হাড়, কাঁটা বা বিপদজনক কিছু দেখে তা অন্যত্র সরিয়ে ফেলাটাও সাদাকা। কোনো তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানি পান করানোটাও সাদাকা। এমনকী যদি কাউকে তার গন্তব্যে পৌঁছতে সঠিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়, তাহলে সেটাও সাদাকা হিসেবে গণ্য হবে।’ বুখারি : আল-আদাবুল মুফরাদ : ৮৯১

ইসলাম সব সময় তার অনুসারীদের আল্লাহর রাস্তায় এবং অভাবীদের জন্য সম্পদ ব্যয় করার নির্দেশ দেয়। সেইসাথে কৃপণতা, লোভ আর সংকীর্ণ মানসিকতার বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থানও খুবই স্পষ্ট। একটি হাদিসে এসেছে-

‘দানকারী ব্যক্তি আল্লাহর অতিশয় নিকটে থাকেন, জান্নাতেরও কাছে থাকেন। দোজখ তার থেকে দূরে থাকে। আর যে কৃপণ, সে আল্লাহর থেকেও দূরে, মানুষ থেকেও দূরে, জান্নাত থেকেও দূরে; কিন্তু দোজখ তার খুবই কাছে। একজন শিক্ষিত কৃপণের চেয়ে অশিক্ষিত দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয়।’ তিরমিজি

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, 

‘যে ব্যক্তি ইসলামের একটি ভালো আদেশ পালন করল, সে তার সওয়াব ঠিকই পাবে। এমনকী অন্যদের সেই আমলটি করতে বললে, তারাও একই সওয়াব পাবে। যদিও কারও সওয়াবই তাতে কমে যাবে না। অন্যদিকে যে কোনো খারাপ কাজ করল, সে তার শাস্তি পাবে। এই খারাপ কাজটিতে আরও যত লোককে সম্পৃক্ত করা হবে, তারাও তার শাস্তি পাবে। কারও শাস্তি অন্য কারও জন্য কম হবে না।’ মুসলিম

ইসলাম মানুষকে বোঝায়- সম্পদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত লোভ তার পতন ডেকে আনবে। কেউ যদি তার এই পরিণতি আগে থেকে বুঝতে পারে, তাহলে সে দানের চর্চায় ডুবে যাবে। কারণ, স্বার্থপরতার চেয়ে দান উত্তম আর কৃপণতার থেকে উপহার প্রদান করা অধিকতর উত্তম।

রাসূল ﷺ বলেছেন-

‘ভালো ও ন্যায়নিষ্ঠ কাজ মানুষকে খারাপ কাজের অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা করে। গোপনে দান করলে বান্দার ওপর আল্লাহর রাগ কমে যায় এবং দয়া বেড়ে যায়। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ব্যক্তির আয়ুও বৃদ্ধি করে।’ তাবরানি : ৬০৮৬

শয়তানকে আঘাত করতে চাইলে কিংবা তার নোংরা কূটকৌশলকে পরাভূত করতে চাইলে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো- দান-সাদাকা বৃদ্ধি করা এবং আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করা। আর এই কারণেই শয়তান মানুষকে কৃপণ ও সংকীর্ণমনা বানাতে চেষ্টা করে; যেন মানুষের ভেতরে দান করার মানসিকতা না তৈরি হয় এবং সে এই বস্তুজগতের ভালোবাসায় পড়ে যায়।

কে দরিদ্র:

‘হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত। রাসূল ﷺ বলেছেন, “তোমরা কি জানো দরিদ্র কে?” উপস্থিত লোকেরা বলল, “আমাদের ভেতরে দরিদ্র হচ্ছে সেই ব্যক্তি- যার নগদ অর্থও নেই, কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তিও নেই।” রাসূল ﷺ বললেন, “আসল দরিদ্র হলো সেই ব্যক্তি- যে কিয়ামতের দিন সালাত, সিয়াম, ও জাকাত সাথে নিয়ে যাবে, কিন্তু এমন অবস্থায় যাবে যে সে একইসঙ্গে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারও সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছে, কারও রক্ত ঝরিয়েছে অথবা কাউকে মারপিট করেছে। এমতাবস্থায় সে যাদের ক্ষতি করে যাবে, তাদের এক একজনকে এই ব্যক্তির সব নেক কাজগুলো ভাগ করে দেওয়া হবে। এভাবে দিতে দিতে তার দায় মুক্ত হওয়ার আগে যদি তার নেক আমলগুলো শেষ হয়ে যায়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের গুনাহগুলো সেই ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”‘ তিরমিজি : ২৪১৮, মুসনাদে আহমদ : ৮০২৯

নৈতিকতা এবং ঈমানের মধ্যকার অন্তর্নিহিত সম্পর্কটি রাসূলের ﷺ এই হাদিসটি দিয়েও প্রমাণ হয়। প্রিয়নবি ﷺ বলেছেন-

‘যদি কোনো মানুষ সালাত, সিয়াম কিংবা হজ পালন করে, তথাপিও তাকে ভণ্ড বা প্রতারক বলা যায়- যদি তার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে। এগুলো হলো- যখন সে কথা বলে সে মিথ্যা বলে, যখন সে ওয়াদা করে তা সে ভঙ্গ করে এবং সে অন্যের আমানত বা আস্থা নষ্ট করে বা চুক্তি ভঙ্গ করে।’ মুসলিম : ৪৩

আরেকটি হাদিসে রাসূল ﷺ বলেছেন-

‘চারটি বৈশিষ্ট্য থাকলে একজন ব্যক্তিকে ভণ্ড বা প্রতারক বলা যায়। এমনকী এর কোনোটি যদি কারও ভেতরে থাকে, তাহলেও তার ধ্বংস ও বিচ্যুতি অনিবার্য। এগুলো হলো- যখন সে অন্যের আমানতের খেয়ানত করে, মিথ্যা কথা বলে, চুক্তি করলে তা ভঙ্গ করে এবং কোথাও কোনো ঝগড়ায় লিপ্ত হলে সে গালি-গালাজ শুরু করে।’ বুখারি : ৩৪

ইসলামে নৈতিকতা উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লাভের গুরুত্ব কতটা?

যেখানে প্রচলিত অন্য সব ধর্ম কেবল ধর্মীয় আচারাদি পালনের দিকে বেশি নজর দেয়, সেখানে ইসলাম সকল ইবাদাত ও আমলের পাশাপাশি উত্তম চরিত্রকে গুরুত্ব দিয়েছে। রাসূল ﷺ তাঁর দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছিলেন এমন কিছু রাষ্ট্রপ্রধানকে, যারা নানা ধরনের দেব-দেবীর পূজায় লিপ্ত হয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। সেই বাস্তবতায় ইসলামের অনুসারীর সংখ্যা যখন ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছিল এবং বিভিন্ন যুদ্ধে ও অভিযানে যখন মুসলমানরা সফলতা লাভ করছিল, ঠিক তখনও আল্লাহর রাসূল ﷺ চরিত্র সাধনের কথাই বারবার বলে গেছেন। এতে বোঝা যায়, ইসলামে নৈতিকতা ও উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লাভের গুরুত্ব কতটা বেশি।

কিন্তু ইসলাম এত সাদামাটা চিন্তার কথা বলে না। ইসলামের মতে, ইবাদাত তখনই কবুল হবে কিংবা ইবাদতের মাধ্যমে পাপ তখনই বিলীন হবে, যখন আমলদার ব্যক্তি উৎকৃষ্ট গুণাবলি অর্জন করতে পারবেন কিংবা তিনি অপরের হকগুলো যথাযথভাবে আদায় করতে পারবেন।

 রাসূল ﷺ বারবার এই নীতির ওপর জোর দিয়েছেন যেন উম্মাহ নৈতিকতার কদর বুঝতে পারে, যেন তাদের নৈতিকতা সমুন্নত থাকে এবং চরিত্রকে আরও উন্নত করার জন্য উম্মাহর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। চারিত্রিক উৎকর্ষতার বিষয়কে এড়িয়ে গিয়ে উম্মাহ যেন সাধারণ ধর্মীয় আচারাদি পালনে বেশি ব্যস্ত না হয়।

‘হজরত আবু জাফর থেকে বর্ণিত। রাসূল ﷺ বলেছেন- সফল ব্যক্তি তো সে, যে ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে তার অন্তরকে বিশুদ্ধ করে, তার মনকে সব সময় সুপথে পরিচালনা করে, সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলে, সব সময় শোকরগুজারি থাকে এবং তার স্বভাব ও আচরণও কোমল থাকে।’ মুসনাদে আহমদ : ২১৩১০

উপদেশ দানকারী:

শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েই মানুষের আস্থা পাওয়া যাবে না। যিনি ভালো পরামর্শ দিচ্ছেন, তার চরিত্র যদি ভালো না হয়, তাহলে তার চারপাশে পরামর্শদাতা ব্যক্তির ব্যাপারে কখনোই ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হবে না। সঠিক ও কার্যকর প্রশিক্ষণ কেবল তিনিই দিতে পারেন, যার সেই ধরনের ব্যক্তিত্ব আছে। যিনি তার উত্তম চরিত্র দ্বারা আশেপাশের মানুষকে সম্মোহিত করে রাখতে পারেন। কোনো ব্যক্তির জীবনযাপন যদি তার কথার সাথে মিলে যায়, তাহলে মানুষ এমনিতেই তাকে অনুসরণ করার তাগিদ অনুভব করবে।

মানবিকতা:

রাসূলের ﷺ যেসব গুণাবলির কথা আমরা জানতে পারি, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে গুণটি সম্পর্কে জানা যায় তা হলো তাঁর মানবিকতা। কোনো কিছুর ওপর তাঁর লোভ ছিল না। তিনি ছিলেন অসম্ভব সাহসী ও বীরোচিত। তিনি সত্য বলতে ও সত্যের পথে দাঁড়াতে কখনো বিচলিত হতেন না। তিনি ছিলেন ন্যায় ও ইনসাফের মূর্ত প্রতীক। তাঁর মনে ভালোবাসা ছিল অফুরান। তিনি কখনো কারও প্রতি অন্যায় করেননি। তাঁর গোটা জীবনটাই ছিল সততা আর বিশ্বস্ততার জ্বলন্ত উদাহরণ।

 ঐক্যবদ্ধতার ও ক্ষমতা অর্জনের গুরুত্ব:

বিশ্বাসের ওপর ঈমানকে জয়ী করার জন্য, পাপাচারের পরিবর্তে সততাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করার পরিবর্তে তাঁর বিধানকে জারি রাখার জন্য সত্যপন্থী লোকদের মধ্যে চিন্তাগত এবং কৌশলগত একতা থাকা খুবই অপরিহার্য। শুধু ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় উপলব্ধি করা যায় যে, এই মানুষগুলো আসলে সত্যের ওপর অটল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

যখন মন আল্লাহর দেওয়া বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রয়াস নেয় এবং প্ররোচণার মধ্য দিয়ে মনকে বিপথে চালাতে চায়, তখন তা থেকে নিজেকে বাঁচানোর সহজ কোনো রাস্তা নেই। সেই কেবল নিজেকে এসব অন্যায় প্ররোচণার হাত থেকে মুক্ত রাখতে পারে, যার ঈমান ও অনুশীলন শয়তানের সেই সব কূটকৌশলের চেয়েও শক্তিশালী। ঈমান ও ধর্মীয় অনুশীলন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আবারও ভারসাম্যমূলক একটি জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

কেবল ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে সমাজকে এমনভাবে বিনির্মাণ করা যায়- যেখানে ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা যাবে, মন্দ কাজ প্রতিহত করা যাবে, ভালো কাজের বিকাশ ঘটানো যাবে এবং ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক কাজগুলো অব্যহত রাখা যাবে।

ইসলাম বলে, প্রকৃতির বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে এবং নিজের ভেতরকার বিদ্রোহী মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আত্মার প্রশিক্ষণ ও সংস্কারের জন্য নিয়মিত পরিচর্যা এবং নজরদারির কোনো বিকল্প নেই। আর সেক্ষেত্রে উত্তম চরিত্র গঠনই হলো একমাত্র কার্যকর কৌশল।

ইসলাম বলে একটি জাতির অস্তিত্ব ও ধারাবাহিক উন্নতি, তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্থান ও বিকাশ এবং ক্ষমতা ও সক্ষমতার একমাত্র গ্যারান্টি হলো নৈতিকতা। যদি জনগণ নৈতিক চরিত্রের দিক থেকে উন্নত হয়, তাহলে জাতিগতভাবেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আর যদি নৈতিকতায় কোনো ঘাটতি থাকে, তাহলে সেই দেশ বা রাষ্ট্র পতনের মুখে পড়ে যায়।

যদি কোনো জাতি নিজেদের ইসলাম ও কুরআনের অনুসারী বলে দাবি করে, কিন্তু যদি ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হয়, অভাবীদের প্রতি সহানুভূতি না দেখায় এবং জনগণকে সেবা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে না পারে- তাহলে বুঝতে হবে সে জাতি শুধু নামেই কুরআন বা ইসলামের অনুসারী। মূলত সেই সরকার ইসলামের নৈতিক মূল্যবোধ থেকে অনেকটাই সরে গেছে এবং তাদের ওপর আসমান ও জমিনের সকল সৃষ্টি ক্রমাগতভাবে অভিশাপ দিয়ে যায়।

ইমাম ইবনে তাইমিয়ার একটি জনপ্রিয় সংলাপ আছে। তিনি বলেছেন-

‘ন্যায়পরায়ণ সরকারকে আল্লাহ হেফাজত করেন। এমনকী যদি সেই সরকার অধার্মিক বা নাস্তিকরা পরিচালনা করে, তাহলেও তাদের তিনি সুরক্ষা করেন। আর যদি কোনো সরকার স্বৈরাচারী হয়, এমনকী যদি তা মুসলমানরাও পরিচালনা করে তথাপিও আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দেন।’

ইসলাম এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলে, যেখানে শুধু অনুমান বা কুসংস্কার দিয়ে কোনো কিছু পরিচালিত হবে না। যেখানে ভিত্তিহীন কিংবা কল্পিত বিষয়াদিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না, অসদাচারকে উৎসাহিত করা হবে না; বরং যেখানে ঈমানি চেতনাকে বলিষ্টভাবে ধারণ করা হবে, সমাজের সর্বত্র তার প্রতিফলন ঘটবে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্পর্কগুলো নির্মিত হবে।

মিথ্যার ভয়াবহতা:

‘মানুষের যতগুলো বাজে অভ্যাস আছে, তার মধ্যে মিথ্যা হলো নিকৃষ্টতম। যদি রাসূল ﷺ-এর সামনে কেউ মিথ্যা কথা বলত, তাহলে সেই ব্যক্তির ব্যাপারে রাসূল ﷺ-এর মনে অসন্তুষ্টি থাকত- যতক্ষণ না সে আবার অনুতপ্ত হয়।’ ইবনে হিব্বান

মুসলিম সমাজের একটি বৈশিষ্ট্যই হলো সততা, শৃঙ্খলা, সহিষ্ণুতা, কথা বলায় সতর্কতা প্রভৃতি। অন্যদিকে মিথ্যা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, মিথ্যা অভিযোগ কিংবা ভিত্তিহীন ইস্যুগুলো হলো সমাজে ভাঙন ও বিশৃঙ্খলার উদাহরণ। এগুলোর চর্চা বেশি হলে সমাজ ধর্মের থেকে দূরে সরে যায়। এসব অভিযোগে অভিযুক্তরা যদি নিজেদের ধার্মিক বলে দাবি করে, তাহলে বরং ধর্মের দুর্নাম হয়, ধর্মের নামে ব্যাবসা আরও সম্প্রসারিত হয়। ক্রমান্বয়ে ধর্মের প্রকৃত বৈশিষ্ট্যগুলো বিলীন হয়ে যায়। মিথ্যা, প্রতারণা এবং ওয়াদার ভঙ্গ করাটাই ধর্মের রূপ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।

একটি হাদিসে এসেছে-

‘রাসূল ﷺ বলেছেন- যখন একজন মানুষ মিথ্যা কথা বলে, সেই মিথ্যার কারণে এত বেশি দুর্গন্ধ ছড়ায়; যার কারণে ফেরেশতারা সেই ব্যক্তির কাছেও আসতে পারে না।’ তিরমিজি : ১৯৭২

 জিহাদ:

অনেকে আছে জিহাদ করতে চায়, কিন্তু সাধারণ কোনো সেনা সদস্যের বা পুলিশের বুটের আওয়াজেও ভয় পেয়ে যায়। আবার এমন সম্পদশালী ব্যক্তিদেরও সমাজে দেখা যায়, যারা মনে করে জাকাত দিলে একটা বিরাট অঙ্কের টাকা চলে যাবে- এই আশঙ্কায় রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই ধরনের ব্যক্তিরা কি কখনো সত্যিকারের মুজাহিদ বা দ্বীনের রাস্তায় সম্পদ বিলিয়ে দেওয়া মানুষের মতো সম্মান পেতে পারে?

 আমানতহীনতার ভয়াবহতা:

To Do যে জাতির মধ্য থেকে আমানতদারিতার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যায়, সেই জাতির বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগের বিষয়টা হাসি-তামাশার বিষয়ে পরিণত হয়। সে জাতির যোগ্য লোকগুলো একসময় হারিয়ে যায় এবং তাদের জায়গায় অযোগ্য লোকেরা এগিয়ে আসে। ফলে গোটা জাতি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়।

সবচেয়ে বেশি প্রতারণা করার সুযোগ থাকে সেই মানুষগুলোর যারা জনগণের স্বার্থ নিয়ে কাজ করেন। তিনি যদি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে নিশ্চিন্তে ঘুমান, তাহলে জনগণের ভাগ্যে ধ্বস নামা ছাড়া আর বিকল্প নেই।

আর আখেরি জমানায় এরকম নমুনা বিভিন্ন জাতির ক্ষেত্রে দেখা যাবে বলেও রাসূল ﷺ নিচের এই হাদিসে ইঙ্গিত করে গেছেন।

‘একবার রাসূলের ﷺ কাছে একজন ব্যক্তি এলেন এবং জানতে চাইলেন- হে নবি কিয়ামত কখন হবে? রাসূল ﷺ উত্তর দিলেন, যখন আমানতদারিতা কমে যাবে, তখন বুঝবে যে কিয়ামত সন্নিকটে। রাসূল ﷺ-কে আবার প্রশ্ন করা হলো, আমানতদারিতা কমে যাওয়া মানে কী? রাসূল ﷺ একটু স্পষ্টভাবে উত্তর দিলেন- যখন দায়িত্বগুলো অযোগ্য লোকদের ওপর অর্পণ করা হবে তখনই বুঝবে যে কিয়ামত সন্নিকটে।’ বুখারি

কারও বিবেক যদি কাজ না করে, তাহলে আমানতদারিতার গুণটি তার ভেতর থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যায়। তখন ব্যক্তি যতই কুরআন ও হাদিস পড়ুক না কেন, সে তার প্রকৃত স্বাদ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে না। কুরআনের একজন প্রকৃত পাঠক কখনোই অন্যের হক নষ্ট করতে পারে না। কারও আমানতের খেয়ানত করতে পারে না।

দেনমোহর পরিশোধের গুরুত্বঃ

স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার থেকে এক টাকাও আত্মসাৎ করার বা পরিশোধ না করার অধিকার স্বামীর নেই। মোহরানা বা বিয়ের চুক্তিকে কম গুরুত্বপূর্ণ ভাবারও কোনো সুযোগ নেই। হাদিসে এসেছে-

‘যদি কোনো পুরুষ এক দিরহাম বা এক টাকার চুক্তিতেও কোনো নারীকে বিয়ে করে, কিন্তু তার মনে এমন খায়েশ থাকে যে সেই উক্ত অর্থ পরিশোধ করবে না, তাহলে সেই বদ খায়েশের মাধ্যমে আসলে সে তাকে তালাক প্রদান করেছে।

যদি এমতাবস্থায় স্বামী মারা যায় যে, সে তার স্ত্রীর প্রাপ্য টাকা পরিশোধ করেনি, তাহলে কিয়ামতের দিন একজন ধর্ষক হিসেবে আল্লাহর সামনে সে উপস্থিত হবে। আর যদি কোনো মানুষ অপরের কাছে ধার নেওয়ার সময়ও তা পরিশোধ করার ইচ্ছা না রাখে, তাহলে সে আসলে তাকে ঠকাল, প্রতারণা করল। যদি এ অবস্থায় ঋণ গ্রহণকারী ব্যক্তির মৃত্যু হয়, তাহলে সে কিয়ামতের দিন একজন চোর হিসেবে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে।’ তাবরানি : ১১১

তথ্যসূত্রঃ মুসলিম চরিত্র, মুহাম্মাদ আল গাজালি

সাধারণভাবে বলতে গেলে একটি সমাজ একজন সাধারণ গরিব লোকের চেয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ভণ্ডামি থেকেই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কারণ, তারা অপরাধ করতে করতে এক রকমের অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাদের কাছে নিজেদের অন্যায়গুলো আর অন্যায় বলে মনে হয় না। মেধাবী মানুষরা যদি নিষ্ঠাবান না হয়, তাহলে তাদের মেধা বা প্রজ্ঞা বরং সমাজ ও দেশের জন্য অভিশাপ হয়ে ওঠে। এই ধরনের সমাজ উন্নতি করার চেয়ে পেছনের দিকেই বেশি ধাবিত হয়। আর ব্যক্তি তার নিজের মধ্যে ভেজাল বজায় রেখে যদি কোনো ভালো কাজও করতে চায়, তাহলে সেই ভালো কাজটিও খুব একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না। এটাও এক ধরনের অন্যায়, যেটা কিনা কর্তব্যনিষ্ঠার অভাবেই সংঘঠিত হয়।

হাদিসে বলা হয়েছে-

‘শুধু অহংকারের কারণে জ্ঞানার্জন করো না কিংবা জ্ঞান লাভ করে সেটা নিয়ে মূর্খদের সাথে অহেতুক ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ো না। যদি কেউ এসব উদ্দেশ্যে জ্ঞান অর্জন করে, তাহলে সে তার জন্য জাহান্নামকে নির্ধারণ করে ফেলবে।’ ইবনে মাজাহ

সত্য আর মিথ্যার পথের পথিকের মধ্যে কত বিশাল পার্থক্য। একদল মানুষ জেনেশুনে এই বৈষয়িক জগতের ঐশ্বর্যকে ছুড়ে ফেলে দেয় আর অন্যদলের মানুষরা বড়ো পদে যাওয়ার জন্য কিংবা ছোটোখাটো কোনো সুবিধা লাভের লোভে পরকালের স্থায়ী জীবনকে নিয়ে তামাশা করে। তারা দুনিয়ায় সফল হওয়ার জন্য তাদের ধর্ম ও ঈমানকে ত্যাগ করতেও দ্বিধা করে না।

কথাবার্তার আদবঃ

ইসলাম মানুষের কথাবার্তা, স্টাইল, আদব কায়দা এবং আচরণের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেছে। কারণ, একজন মানুষের বুদ্ধিমত্তা কী মানের সেটা তার মুখ নিঃসৃত কথা থেকেই বোঝা যায়। ঠিক তেমনি যদি কোনো দলের সদস্যদের কথাবার্তার আদব মানসম্পন্ন হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে গোটা সাংগঠনিক পরিবেশটাই ভালো হয়ে যায়।

হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ বলেছেন-

‘এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো কারাগার হলো মানুষের মুখের জিহ্বা।’ তাবরানি

‘হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস বলেছেন- একটি শক্তিমান কালো ঘোড়ার চেয়েও পাঁচটি জিনিস উত্তম। এগুলো হলো-

১. বাড়তি কথায় জড়াবেন না। কারণ, এসব কথার অধিকাংশই অহেতুক ও যুক্তিহীন। আর আমি সব সময়ই পাপ করার ভয়ে ভীত থাকি। কথা বললে পাপ করার সুযোগও বেড়ে যায়।

২.

যখন প্রয়োজন পড়বে, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে এ সংক্রান্ত কথা বলুন। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবেন না। এটা আপনার জন্য ক্ষতির কারণ হবে।

৩. কোনো বুদ্ধিমান বা বোকা লোকের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে জড়াবেন না। যদি সে বুদ্ধিমান হয়, তাহলে সে আপনার ওপর রাগ করে আপনাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে আর যদি সে বোকা ও অশিক্ষিত হয়, তাহলে সে আপনার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।

৪. যদি আপনার কোনো ভাই সম্পর্কে কথা বলেন আর সে উপস্থিত না থাকে, তাহলে এমন ভঙ্গিতে কথা বলবেন যেন সে আপনার পাশেই আছে। আর আপনি তার যেসব বিষয়ে ভালো মনে করবেন, সেসব বিষয়ে তাকে ভালোই মনে করবেন।

৫. সেই মানুষটির মতো হওয়ার চেষ্টা করুন, যে সব সময় পুরস্কার পাওয়ার জন্য কাজ করে আর অপরাধ করার ভয়ে তটস্থ থাকে।’ ইবনে আবি আল দুনিয়া।

একজন মানুষ তখনই এসব গুণাবলি অর্জন করতে পারে, যখন সে তার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে এবং যেখানে প্রয়োজন সেখানে নীরব হয়ে যেতে পারে; আবার যেখানে প্রয়োজন সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কথাও বলতে পারে। যারা উলটো নিজেদের জিহ্বার দাস হয়ে যায়, তারা সব সময়ই লোকসানের মুখে পড়ে, সারা জীবন ধরেই অপমান ও লাঞ্ছনার মুখে পড়ে।

ইসলাম নীরবতাকে স্বীকৃতি দেয় এবং নীরবতার এই গুণটিকে এক ধরনের সভ্যতা ও মার্জিত আচরণের পরিমাপক হিসেবে বিবেচনা করে। হজরত আবুজর বলেছেন-

‘তোমরা নীরবতা অবলম্বন করো। নীরবতাই শয়তানকে দূরে রাখার কার্যকর একটি উপায়। আর নীরবতা তোমাকে সবদিক দিয়ে সাহায্য করবে এবং তোমার দ্বীনকেও সুরক্ষা করবে।’ ইবনে হিব্বান : ৩৬১

মানুষের ঈমানের একটি বড়ো সৌন্দর্য হলো অপ্রয়োজনীয় কাজ করা ছেড়ে দেবে।’ তিরমিজি

ইসলাম অহেতুক কথা ও কাজকে সব সময় প্রত্যাখান করেছে। কারণ, ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এসব ভাসাভাসা ও অপ্রয়োজনীয় কাজের কোনো গুরুত্ব নেই। যে মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাকে এতটা সম্মান দেওয়া হয়েছে; সেদিকে না তাকিয়ে মানুষ অন্য সব গুরুত্বহীন কাজে ব্যস্ত থাকবে- এটা ইসলাম অনুমোদন করে না। অপ্রয়োজনীয় কাজ ও কথা থেকে একজন মুসলমান যত দূরে যেতে পারবে, আল্লাহর কাছে তার সম্মান ও গুরুত্ব ততটাই বৃদ্ধি পাবে।

পরিচ্ছন্ন এবং মার্জিত কথাবার্তায় বন্ধু বা শত্রু সবাই সন্তুষ্ট হয়। এর উত্তম ফলাফলও উপভোগ করা যায়। সুকথন দুটো বন্ধুর মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করে। এটা বন্ধুত্বকে মজবুত করে, স্থায়িত্ব বাড়ায় এবং সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য শয়তান যে কূটকৌশল চালায়- সেগুলোকে পরাভূত করে।

মুসলমানদের সব অবস্থায় ভালো আচরণ ও সুন্দরভাবে কথা বলার জন্য আহ্বান জানিয়ে রাসূল ﷺ বলেন-

‘তুমি তোমার সম্পদ দিয়ে অন্যের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। কিন্তু সুন্দর ব্যবহার ও আচরণ দিয়ে তুমি ঠিকই তার মন জয় করতে পারবে।’ আল বাজ্জার : ৮৫৪৪

শালীন কথাবার্তা এমন একটি অভ্যাস, যাকে উত্তম গুণাবলি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর যে এই চর্চাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলতে পারে, সে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারে। তাঁর অসীম নিয়ামতও লাভ করতে পারে।

‘হজরত আনাস বর্ণনা করেন যে, একবার এক ব্যক্তি রাসূলকে ﷺ এমন একটি গুণ সম্পর্কে বলতে বলল, যা তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। নবিজি বললেন- গরিবকে খাবার দাও, সালামের চর্চা বৃদ্ধি করো, গভীর রাতে তাহাজ্জুদের সালাত পড়ো। তাহলে তুমি শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।’ আল বাজজার : ২৬৪২

একজন বোকা ও নির্বোধ লোককে শ্রদ্ধা করার মানে এটা নয় যে, তার যাবতীয় নিম্নমানের কাজগুলোকেও আমাদের মেনে নিতে হবে। দুটো বাস্তবতা আসলে পুরোটাই ভিন্ন। শ্রদ্ধা করা বলতে বোঝায়, যে মানুষ একজন নির্বোধের নির্বুদ্ধিতার সামনেও নিজেকে ধরে রাখতে পারবে, সংযত রাখতে পারবে। সে এমন কোনো কাজ করবে না যেন নির্বোধ ব্যক্তিটি এমন কিছু কাজ করার সুযোগ পায়, যা দেখে তার রাগ ও ক্ষোভ বেড়ে যাবে এবং তার প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছা করবে।

রাসূল ﷺ বলেছেন-

‘যে ব্যক্তি বিতর্কিত বিষয়ে আলোচনা এবং অযৌক্তিক কথাবার্তা পরিহার করে চলে, তার জন্য জান্নাতের নিচের অংশে একটি ঘর তৈরি হয়। আর যে তার নৈতিকতাকে সংশোধন করে চলে, তার জন্য জান্নাতের ওপরের অংশে একটি ঘর তৈরি হয়।’ আবু দাউদ

রাসূল ﷺ বলেছেন-

‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় ব্যক্তি তারা, যারা অহেতুক তর্ক করে বেড়ায়।’ বুখারি

মুসলমানের জীবনযাপন:

একজন মুসলমানের এমনভাবে জীবনযাপন করা উচিত, যেন সে সকলের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় এবং মানুষের কষ্ট ও যন্ত্রণাগুলোতে শরিক হতে পারে। একজন মুসলমানের উচিত সব সময় তার জীবন নিয়ে খুশি ও কৃতজ্ঞ থাকা। তার উচিত সব ধরনের হিংসা ও প্রতিহিংসা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। হিংসা থেকে মন যেভাবে কলুষিত হয়, তা এক ভয়ংকর রোগ তৈরি করে। আর কোনো অন্তর এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হলে তাতে ঈমান স্বাভাবিকভাবেই হারিয়ে যায়, দুর্বল হয়ে যায়।

ইসলাম সব সময়ই অন্তরকে বিশুদ্ধ রাখার ওপর জোর দেয়। কারণ, দূষিত অন্তর সকল ভালো কাজকেও নষ্ট করে ফেলে। দূষিত মন অন্তরের সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করে। আর মানুষের অন্তর যদি আলোকিত থাকে, তাহলে আল্লাহ কোনো ক্ষুদ্র কাজের জন্যও অনেক বেশি নিয়ামত প্রদান করতে পারেন। তখন ভালো জিনিসগুলোও অন্তরে অনেক বেশি দ্রুততার সাথে ও কার্যকরভাবে প্রবেশ করতে পারে।

হজরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বর্ণনা করেছেন-

‘একবার রাসূল ﷺ-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোন গুণের অধিকারীরা মহান মানুষ? নবিজি উত্তর দিয়েছিলেন, সেই মানুষগুলো মহান যাদের অন্তর একেবারে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন এবং যাদের জিহ্বা সব সময় সত্য কথা বলে। সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, জিহ্বার ব্যবহার নিয়ে আমরা সতর্ক রয়েছি। কিন্তু পরিচ্ছন্ন অন্তর বলতে আপনি কী বুঝিয়েছেন? নবিজি জানালেন- সেই অন্তরগুলোই পরিচ্ছন্ন যার মধ্যে আল্লাহর ভয় থাকে, পাপ থেকে মুক্ত থাকে এবং যেখানে কোনো জেদ, হিংসা ও প্রতিহিংসার অস্তিত্ব থাকে না।’ ইবনে মাজাহ।

সত্যিকার মুসলিম সমাজ বলতে  সেই সমাজকেই বুঝানো হয়, যা পারস্পরিক ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সঠিক লেনদেনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মুসলিম সমাজে অকৃতজ্ঞ বান্দা থাকার কোনো সুযোগ নেই। এখানে হিংসার চর্চা করার কোনো সুযোগ নেই।

অনেক সময় অন্তর্নিহিত ঈর্ষা ও হিংসা মানুষকে এত বেশি মাত্রায় প্রভাবিত করে যে, সে বানিয়ে মিথ্যা গল্প বলতেও দ্বিধা করে না। ইসলাম এ ধরনের সকল চর্চাকে প্রত্যাখান করে এবং মানুষকে এসব বাজে অভ্যাস থেকে দূরে থাকার তাগিদ দেয়। ইসলাম বলে, এসব অনাচার থেকে দূরে থাকাই উৎকৃষ্ট ইবাদাত। যেমনটা রাসূল ﷺ বলেছেন-

শোনো, আমি কি তোমাদের এমন একটা বিষয় সম্পর্কে বলব যা সালাত, সিয়াম এবং দান-সাদাকার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ? শ্রোতারা বললেন, বলুন আল্লাহর রাসূল। অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা পারস্পরিক সম্পর্ককে সঠিক ভিত্তির ওপরে রাখবে। কারণ, পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে কোনো সমস্যা থাকলে তা উলটো পরিচ্ছন্নতাকে ছেঁটে দেয়। আমি চুল ছেঁটে দেওয়ার কথা বলছি না; বরং এটা ধীরে ধীরে দ্বীনকে, দ্বীনের সৌন্দর্যকেই ছেঁটে দেয়।’ তিরমিজি।

যখন মানুষের অন্তরে খারাপ জিনিস স্থায়ীভাবে গেঁথে যায়, যখন ভালোবাসা ও ভাতৃত্ববোধকে ছুড়ে ফেলে দেয়, তখন মানুষ নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। তার মধ্যে শত্রুতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সে তখন আল্লাহর সুপারিশকৃত সম্পর্কগুলো ধ্বংস করতেও দ্বিধাবোধ করে না। আর এর মাধ্যমেই তারা পৃথিবীতে দুর্নীতি আর অনাচারের চর্চা বাড়াতে সাহায্য করে।

রাসূল ﷺ নিজেও বলেছেন-

‘তোমরা সম্পর্ক ছিন্ন করো না। তোমরা পারস্পরিক শত্রুতায় লিপ্ত হয়ো না। তোমরা একে অন্যের বিরুদ্ধে হিংসা ও ঈর্ষার চর্চা করো না। কারও প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ো না। নিজেদের মধ্যে বন্ধন মজবুত করো। তোমরা আল্লাহর প্রকৃত বান্দা হও। আর এক মুসলমান আর তার অন্য মুসলমান ভাইয়ের সাথে তিন দিনের বেশি সম্পর্ক ছিন্ন করে রাখার অনুমতি নেই।’ বুখারি

কারও অন্তরে যদি ঘৃণা গেঁড়ে বসে, তাহলে ইসলাম একে মানবিক মূল্যবোধের কুরুচি হিসেবেই বিবেচনা করে। কারণ, অন্তরে একবার এসব পাপাচার ঢুকে গেলে, তা থেকে অন্তর আর মুক্ত হতে পারে না; বরং জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। যারা তাদের মনে হিংসা, প্রতিহিংসা, ক্রোধের চর্চা করে এবং সব সময় অন্যের সমন্ধে বিষোদগার করার চেষ্টা করে, তারা শুধু গলা চড়িয়ে আর মেজাজ দেখিয়েই স্বস্তি পায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা অন্যের মন ভেঙে দেয় এবং দুনিয়াতে দুর্নীতি আর পাপাচারের প্রসারে ভূমিকা রাখে।

 গিবতের ভয়াবহতা:

গিবত করা দুর্বল লোকের কাজ। তারাই গিবতে লিপ্ত হয়, যারা প্রচেষ্টা চালাতে অক্ষম।

হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত। রাসূল ﷺ বলেছেন-

‘তোমরা কি জানো গিবত কি? সাহাবিরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূল ﷺ বললেন, তুমি যদি তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কিছু বলো যেটা সে পছন্দ করবে না, তাহলে সেটাই হলো গিবত। সাহাবিরা বললেন, হে রাসূল, ﷺ যদি তার মধ্যে এই দোষটা আসলেই থেকে থাকে তাহলেও কি সেটা গিবত হবে? রাসূল উত্তর দিলেন, যদি তার মধ্যে দোষটা থেকে থাকে তাহলে সেটা গিবত। আর যদি দোষটা না থাকে, তাহলে সেটা হবে মিথ্যা অভিযোগ আরোপের সমতুল্য।’ মুসলিম।

যারা সব সময় অপরের দোষ খুঁজে বের করে, তাদের অধিকাংশই পেশাদার অপরাধীর তুলনায় অনেক বেশি জঘন্য অপরাধ করে। এসব মানুষের অন্তর কখনোই আল্লাহর ভালোবাসা পায় না, পাবে না। কারও অপরাধ যদি খোঁজা হয় এবং যদি তা ফাঁস করার জন্য চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেটা সেই অপরাধ করার তুলনায় অনেক বড়ো অপরাধ।

হিংসা করার ব্যাপারে সতর্কতা:

ইসলাম হিংসাকে নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সব সময় হিংসুটে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে মুক্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। হিংসা হলো এমন একটি বাজে স্ফুলিংগ, যা বুকের ভেতর জন্ম নেওয়ার পর হিংসুটে ব্যক্তি এবং অন্য সবার জন্যই শাস্তির কারণ হয়।

আরেকটি হাদিসে এসেছে-

‘হিংসা থেকে দূরে থাকো। কারণ, হিংসা সব ভালো কাজ আর সুন্দর গুণকে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে।’ আবু দাউদ

যে মানুষ হিংসা করে, প্রকৃতপক্ষে সে দুর্বল, অসহায়, নরম, তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ এবং আল্লাহর যে বিধান গোটা বিশ্বজগতে চলছে তা সম্পর্কেও অসচেতন। এই কারণে যখনই সে কোনো কিছু অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, সে তখন সফল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে নেমে যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, সবাইকে একদিন আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। আমাদের তার কাছেই নিয়ামত ভিক্ষা চাইতে হবে। কারণ, তাঁর কাছেই আছে অফুরন্ত ভান্ডার। আর সেই নিয়ামতের ভান্ডার একক কোনো ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত নয়।

এখানে মনে রাখতে হবে যে, হিংসা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যে অনেক বড়ো পার্থক্য রয়েছে। হিংসার মাধ্যমে সরলভাবে কোনো কিছু অর্জন করার বিষয়টি থাকে না। আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা হলো একটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর দৃঢ় ইচ্ছা রাখা। একজন প্রকৃত আল্লাহর বান্দা কখনো অন্যের অর্জনে হিংসা করে না; বরং সে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যায়।

‘রাসূল ﷺ বলেছেন, মাত্র দুটো বিষয় ছাড়া আর কোনো কিছুতে হিংসা করার সুযোগ নেই। প্রথমত, সেই ব্যক্তির জন্য হিংসা করা যায় যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন আর সে মুক্ত হস্তে তা বিলিয়ে দেয়। আর দ্বিতীয়ত, সেই ব্যক্তির জন্যও হিংসা করা যাবে, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছেন; যার ভিত্তিতে সে সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয় আর এবং জ্ঞান বিতরণে নিয়োজিত থাকে।’ বুখারি।

প্রতি সপ্তাহে প্রতিটি মুসলমানের আমলনামা পর্যবেক্ষণ করা হয়। আল্লাহ প্রতি সপ্তাহেই দেখেন যে, বান্দা তার পরকালীন জীবনের জন্য বিগত সপ্তাহে কী সংগ্রহ করেছে? আর তার মনেই-বা কী অনুভূতি লুকায়িত রয়েছে। যদি তার অন্তর হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকে, তাহলে সে ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়। আর যদি তার মনে হিংসা ক্রোধ প্রতিহিংসা লুকায়িত থাকে, তাহলে সে তার কাজের কোনো বরকত আর পায় না। রাসূল ﷺ বলেছেন-

‘প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমলনামা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। এই দুদিন আল্লাহ শিরককারী ছাড়া সকলের গুনাহ মাফ করে দেন। তবে যদি কোনো মানুষের মনে তার ভাই প্রসঙ্গে হিংসা ও বিদ্বেষ লুকায়িত থাকে, তাহলে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, তাদের অবস্থাকে এভাবেই রেখে দাও, যতক্ষণ না তারা নিজেরা কোনো সমঝোতায় পৌঁছায়।’ মুসলিম।

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের পিতা ও ভাইদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে ভালোবাসে। আর তোমাদের মধ্যে যারা তাদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা সীমালংঘনকারী।’ সূরা আত তাওবাহ : ২৩

মানুষের মর্যাদাঃ

 রাসূল ﷺ বলেন-

‘যখন আল্লাহ এই পৃথিবী সৃষ্টি করেন, তখন এটা অগোছালো ছিল। তারপর আল্লাহ এখানে পাহাড় বসিয়েছেন। তারপর তা এতে স্থিতিশীলতা এসেছে। ফেরেশতারা তখন পাহাড়ের ক্ষমতা ও শক্তি দেখে অবাক হয়েছিল। তারা আল্লাহ তায়ালাকে প্রশ্ন করেছিলেন, হে আল্লাহ, আপনি কি পাহাড়ের চেয়েও শক্ত করে কিছু বানিয়েছেন? আল্লাহ উত্তর দিয়েছেন, হ্যাঁ, লোহা পাহাড়ের চেয়ে শক্ত। ফেরেশতারা আবার প্রশ্ন করল, আপনি কি লোহার চেয়েও শক্ত করে কিছু বানিয়েছেন? আল্লাহ উত্তর দিয়েছেন, হ্যাঁ, আগুনের শক্তি আরো বেশী,

ফেরেশতারা আবার প্রশ্ন করল, আপনি কি আগুনের চেয়েও শক্তিশালী করে কিছু বানিয়েছেন? আল্লাহ উত্তর দিয়েছেন, হ্যাঁ, পানির শক্তি আরও বেশি। ফেরেশতারা প্রশ্ন করল, আপনি কি পানির চেয়েও শক্তিশালী করে কিছু বানিয়েছেন? আল্লাহ উত্তর দিয়েছেন, হ্যাঁ, বাতাসের শক্তি আরও বেশি। ফেরেশতারা প্রশ্ন করল, আপনি কি বাতাসের চেয়েও শক্তিশালী করে কিছু বানিয়েছেন? আল্লাহ উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আদম সন্তান তার চেয়েও শক্তিশালী; যদি সে ডান হাতে এমনভাবে দান করে যে, বাম হাতও জানে না।’ তিরমিজি।

যে মানুষ মিথ্যা ও প্রতারণার সাথে আপস করে না, সে এক সময়ে বিশালতা ও মহত্বের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে যায়। কারণ, এসব বাজে বৈশিষ্ট্য থেকে মূলত মানুষের অর্জনের কিছু নেই। ভালো কাজের আদেশ দেওয়া বা মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার যে দায়িত্ব, সেটা মূলত আসে ব্যক্তিগত উৎকর্ষতা থেকে। কারণ, এটা সেই সব লোকদের পক্ষেই সম্ভব, যারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কথাই চিন্তা করে। এই পর্যায়ে আমরা বলতে চাই- একজন মুসলমানের উচিত সব সময় সব ধরনের পাপাচারের সমালোচনা করা, তাদের আক্রমণ করা। কোনো বড়ো ক্ষমতাশালী লোকের ভয় বা কোনো আত্মীয়তার পরিচয় যেন তাকে এই দায়িত্ব থেকে বিরত রাখতে না পারে। কোনো সমালোচনাই যেন তাকে আল্লাহর পথ থেকে হটিয়ে না নেয়।

রাসূল ﷺ বলেছেন, যখন কোনো ব্যক্তি একজন ভণ্ড ও প্রতারককে সম্মানের সাথে সম্বোধন করে, তখন আল্লাহ অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হয়ে যান। কারণ, এতে আসলে দুটো অপরাধ। প্রথমত, ওই ব্যক্তি আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয় না। আর দ্বিতীয়ত, সে ওই পাপী ব্যক্তিকে সম্মান দেখায়।

রাসূল ﷺ বলেছেন-

‘যে ব্যক্তি একজন মুসলমানকে অসম্মান করার মাধ্যমে নিজের খাবার সংগ্রহ করে, তাকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুন খাওয়াবেন। যে ব্যক্তি একজন মুসলমানকে অসম্মান করার মাধ্যমে নিজের পোশাক সংগ্রহ করে, তাকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন আগুনের পোশাক পরিয়ে দেবেন। আর যে ব্যক্তি একজন মুসলমানের চরিত্র নিয়ে কূটকৌশল চালিয়ে নিজে সম্মান পাওয়ার চেষ্টা করেন, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন তার প্রাপ্য শাস্তি প্রদান করবেন।’ আবু দাউদ

 ধৈর্য ও আশা:

ধৈর্য আর প্রত্যাশা হলো বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমৃদ্ধির দুই মূল মন্ত্র। এ দুটো বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে পারলেই একজন মানুষ যেকোনো ধরনের দুঃসময় মোকাবিলা করতে পারে। সে তখন বিপদে পড়লেও আর হাল ছাড়ে না; বরং তার জীবনের প্রতিটি অংশই অনেক বেশি নিরাপদ হয়। সে অপকর্ম ও দুরাচারের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে। কারণ, একজন মুসলমান হলো আল্লাহর বিশ্বস্ত বান্দা যে সকল অবস্থায় আল্লাহর সামনে বিনয়ী থাকে এবং শুধু তাঁর কাছেই সাহায্য চায়।

বাস্তবতা হলো, একজন মানুষের আচরণ যতটা ভালো হবে, তার অন্তরও আসলে ততটাই বড়ো হবে; আর সেটা হলে তার অন্য মানুষদের সাথে ব্যবহারেও সহিষ্ণুতা থাকবে। সে অন্যের ভুলগুলো সংশোধনের মানসিকতায় বিবেচনা করবে এবং যখন ভুল করা ব্যক্তি ক্ষমা চাইবে, তখন তাকে অবলীলায় ক্ষমা করে দেবে। যদি তাকে কেউ আহত করার উদ্দেশ্যে আঘাতও করে তথাপি সে তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার মানসিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করবে কিংবা তাকে এড়িয়ে যাবে।

অন্ধকারে ডুবে থাকার উপায়:

অন্ধকারে ডুবে থাকার দুটো উপায় আছে। একটি হলো- নতুন কিছু জানতে বা শিখতে না চাওয়া আর দ্বিতীয়টি হলো ধৈর্য ধারণ না করা। জ্ঞানার্জনের অনীহা দূর করতে হলে চাই জ্ঞান, সঠিক উপলব্ধি, আর ধর্মীয় আদেশ-নিষেধ। আর দ্বিতীয় সংকটটি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হলো নিজের খারাপ ভাবনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা এবং সব ধরনের অন্যায় কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করা। ইসলাম আসার আগে আরবরা নিজেদের অজ্ঞতা ও দুষ্কর্ম নিয়ে অহংকার করত।

বইটি থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ পাঠকদের সাথে শেয়ার করার পর অনুরোধ থাকবে বইটি পুরোটা পড়ে নিজেদের ব্যক্তি জীবনে তা পালন করা চেষ্টা করা এবং সকলের জন্য দোয়া করা এবং আমার জন্যও কিছুটা দোয়া করা যাতে জ্ঞান অর্জন অনুযায়ী ব্যক্তিজীবনে হলেও আমল করতে পারি।

বইয়ের নাম: মুসলিম চরিত্র (সুন্নাহর চোখে চরিত্র গঠনের অবকাঠামো)

লেখকের নাম: শাইখ মুহাম্মাদ আল গাজালী

অনুবাদকের নাম: আলী আহমাদ মাবরুর

প্রকাশনা: গার্ডিয়ান পাবলিকেশনস

পৃষ্ঠা: ১৯৯

মূদ্রণ মূল্য:৩০০.০০

[নোট: সকলের সাথে জ্ঞান শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই আমার বই আলোচনা পোষ্টটি শেয়ার করা। যদি কোনো ভুল-ভ্রান্তি বা ত্রুটি থেকে থাকে দয়া করে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখে ত্রুটিগুলো সংশোধন করে দিবেন যাতে আমি এবং সকলে সঠিকটি জানতে পারি।]

রিভিউটি করার তারিখ: ২৩ আগস্ট ২০২০

ক্যাটাগরিসমূহ
বিষয় ভিত্তিক আলোচনা

আরব শাসক-ফিলিস্তিন-ইসরাইল এর অম্ল-মধুর সম্পর্ক ও ডিল অফ সেঞ্চুরি:

যদি বলা হয় দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বেশি নির্মমতার প্রদর্শনী চলে আসছে কোথায়? উত্তর হবে, ফিলিস্তিনের বুকে। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে পৃথিবীর সকল ইহুদিদের সেখানে নিয়ে ইসরাইলি রাষ্ট্রকে বড় করে স্থানীয় আরবদের নির্যাতনের শিকার বানানো হচ্ছে সকল নীতিবানদের চোখের সামনেই।
ফিলিস্তিনি যুবক ও শিশুরা নিজেদের অসহায়ত্ব সত্ত্বেও পাথর ও গুলতি নিয়ে ময়দানে অবস্থান করছে। আর যারা এদের দায়িত্বশীল হতে পারত, সেই নেতৃত্বধারীরা আরব ভূমিতে খ্রিষ্টানদের মিত্র হিসেবে তাদের সৈন্যদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে চলছে। যা মূলত ফোরাত নদী পর্যন্ত ইসরাইলের একক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে।
আরব শাসকরা হয়তো ভয় পাচ্ছে, আমেরিকাকে ক্ষেপিয়ে তুললে যদি তাদের নিজেদের সিংহাসনেই আগুন লেগে যায়।ইহুদিদের জঘন্য অত্যাচার দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে থাকা যে কত বড় অন্যায় এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণে তার শাস্তি তারা পৃথিবীতেই ভোগ করবে ইনশাআল্লাহ! আমেরিকার রোষানলে পড়ে তো আল্লাহর আশ্রয় নেওয়া যায়; কিন্তু আল্লাহর বিচারের মুখে পড়লে কি কোথাও আশ্রয় নেওয়া সম্ভব?
ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে তৎকালীন সময়ে বাদশা ফাহাদের বিনয়ী আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যখন আমেরিকা তাদের সৈন্যদের সউদি আরবে পাঠিয়েছিল তখন তারা একটি শর্তারোপ করেছিল। তাদের শর্তটি ছিল, যেহেতু কোনো সাউদি নাগরিক বা ভিন্ন দেশের নাগরিক আমেরিকায় পাঁচ বছর অবস্থান করে, তাকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। তেমনিভাবে যেসব আমেরিকান সৈন্য পাঁচ বছর বা তদূর্ধ্বকাল সাউদি আরবে অবস্থান করবে, তাদেরকেও নাগরিকত্ব দিতে হবে। সাউদি বাদশা তার সভাসদদের পরামর্শক্রমে এ শর্তটির মঞ্জুর করেছিলেন।
আমেরিকান অগনিত সৈন্যের সাউদি আরবে আসার প্রায় ১২ বছর এবং নাগরিকত্ব প্রাপ্তির ৭ বছরের বেশী সময় অতিবাহিত হয়েছে ( তথ্যসূত্রে দেয়া বইটি যখন লেখা হয়েছে সেই সময় থেকে)। স্বাভাবিকভাবেই কোনো শহরে নতুন করে নাগরিকত্ব পাওয়ার পর একটি জাতির পরবর্তী পরিকল্পনা থাকে সেখানকার কর্তৃত্ব গ্রহণ করা। ইহুদিদের পরিকল্পনা হচ্ছে, খায়বার থেকে তাবুক পর্যন্ত সর্বোচ্চ পরিমাণে জায়গার মালিকানা অর্জন করা। আরবের আমেরিকার কোম্পানিতে কর্মরত ইহুদি অফিসাররা কারণে-অকারণে এখানে বড় বড় জায়গা ক্রয় করছে। ক্রয় করার ক্ষেত্রে জায়গার অবস্থা এবং মূল্যকে তারা ভ্রূক্ষেপই করছে না। যেকোনো মূল্যে যেকোনো মানের জায়গা ক্রয় করছে।
ইহুদিদের সম্পর্কে তিনটি বিষয় আরব দায়িত্বশীলদের ভাবা উচিত ছিল এবং ভাবা উচিত:
. ইসরাইলের পার্লামেন্টে এ কথা লেখা আছে ‘হে ইসরাইল, তোমার সীমা নীলনদ হতে টাইগ্রিস নদী পর্যন্ত।’
২. ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ইহুদিরা যখন বায়তুল মাকদিসের পুরাতন অংশ দখল করে, তখন ইসরাইলের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তাদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু বোরাক দেয়ালের পাশে পৌঁছে। সবার উপস্থিতিতে সে এ ঘোষণা দেয়—’এখন ইয়াসরিব তথা মদিনা পর্যন্ত যাওয়ার পথ সুগম হলো।’
৩. প্রথম ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেছিল, ‘জেরুজালেম ব্যতীত ইসরাইল অসম্পূর্ণ; আর সুলায়মানি কাঠামো নির্মাণ ব্যতীত জেরুজালেম দখলও অর্থহীন।’
উপরোক্ত উদ্দেশ্য পূরনে তারা যা যা করা দরকার বৈধ-অবৈধ যেভাবে পারে, তাই করছে। আর এতে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে দুনিয়াপ্রেমিক বিকৃত মস্তিষ্ক আরব শাসকরা তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে।


কিন্তু এ কথা সবার মনে রাখা উচিত, সাউদি বাদশাদের প্রতি মুসলমানদের যতটা আবেগ ও ভালোবাসা রয়েছে, তা শুধু হারামাইনের পবিত্র ভূমি মক্কা-মদিনার কারণে। যদি তারা সেই পবিত্র ভূমির সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতেই না পারে, তাহলে নিজেদের মর্যাদা হারাবে। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে তাদের মর্যাদা নেইও। সচেতন মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাদের কে আমেরিকা ও ইসরাইলের পাপেট মনে করে।
আরব নেতৃবৃন্দ তো এতটুকু করতে পারতো যে ফিলিস্তিনবাসীকে তাদের সামর্থ মতো অর্থ, শক্তি, অস্ত্র দিয়ে সমর্থন করা। এতে মসজিদে আকসাকে যদি ফিরে না-ও পাওয়া যেতো; কিন্তু তার জন্য জীবনটাকে বিসর্জন তো দেওয়া যেতো। কিন্তু শুধু ফিলিস্তিনবাসীরাই শুধু জীবন দিয়ে যাচ্ছে অথচ মসজিদুল আকসা শুধু তাদেরই নয় পুরো মুসলিম বিশ্বের সম্মানের ও ভালোবাসার পবিত্র স্থান। এখন অন্য মুসলমানদের ভাবার বিষয় হচ্ছে, যদি পরিস্থিতি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে মুসলিম উম্মাহর এ পুষ্পোদ্যানের কী হবে? এ ভয়াবহ সময়েও যদি ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানো না হয় তাহলে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে যেখানেই মুসলমানরা সংখ্যালঘু রয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিধর্মীদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ অব্যাহত রয়েছে, তাদের পরিত্রাণের কী উপায় হবে? চিনের উইঘুর, ভারতের কাশ্মির, মিয়ানমারের আরাকান সহ আরো কত স্থানে মুসলমানরা লাঞ্চিত জীবন যাপন করতে হচ্ছে সামর্থবান ও শক্তিশালী মুসলিম নেতৃবৃন্দের স্বার্থপরতা ও অদূরদর্শীতার কারনে।

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। জেদ্দায় নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম এডির হাতে ‘গোপনীয় গুরুত্বপূর্ণ’ শিরোনামের একটি পত্র আসে। সেই চিঠিতে বলা হয় তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট সাউদি বাদশাহ আবদুল আজিজের সাথে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী এবং আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে এর ব্যবস্থাপনা করার আদেশ দেওয়া হয়।
যদি সেই বৈঠকের যাবতীয় সিদ্ধান্তকে যদি এক বাক্যে প্রকাশ করা হয়, তাহলে যা দাড়ায় তাহলো;
ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাউদি বাদশাহকে আয়ত্তে আনা, সাউদি আরবের আল্লাহ প্রদত্ত খনিজ পদার্থসমূহকে লুণ্ঠন করা এবং এর বিনিময়ে আরবদের অর্জনকৃত মুদ্রাকে তাদের সামরিক শক্তিতে খরচ না করে শুধু বিনোদনের পিছনে খরচ করানো।
ঐ বৈঠকটি হওয়ার পরই ১৯৪৮ সালে পৃথিবীর বুকে অতীতের ৩ হাজার বছরের ইতিহাসকে চমকে দিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

শেষ পর্যন্ত যা ঘটেছিল তা হলো—সাউদি আরব ফিলিস্তিন-লাগোয়া নিজেদের সীমান্ত সরিয়ে নেয়, যেন ফিলিস্তিন আর তাদের প্রতিবেশীই না থাকে। যেন কেউ সাউদি আরব থেকে ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করতে না পারে। ফিলিস্তিনিরাও যেন শরণার্থী হয়ে মহামান্য আল্লাহর প্রতিনিধির আশ্রয়প্রার্থী হয়ে আসতে না পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে অতীতে নাকি কখনো এমন হয়নি যে, কোনো দেশ গোপনে নিজের অংশকে বিচ্ছিন্ন করে অন্যের হাতে অর্পণ করেছে। কিন্তু বীরের জাতি সাউদি শাসকগণ এই মহান কার্যটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন—তারা ফিলিস্তিনের লাগোয়া বর্ডার অঞ্চলকে জর্ডানের হাতে অর্পণ করে পিছিয়ে এসেছিলেন। যেন আর কোনো মুসলমান আত্মমর্যাদাবোধ হেতু ইহুদিদের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে না উঠে। আবার প্রতিবেশী অঞ্চলে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহযোগিতার বদনামও যেন সাউদি বাদশাদের সাদা পোশাকে কলঙ্কের তিলক এঁকে না দেয়। কি লজ্জার কথা।

এরও অনেক আগে উসমানি খেলাফতের শেষ সময়ে মক্কা মুকাররামার গভর্নর শরিফ হুসাইন, অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু মনোভাবের অধিকারী এই লোক, ইংরেজদের সহায়তায় আরবের পবিত্র ভূমি শক্তিশালী উসমানি খিলাফাতের আয়ত্তের বাইরে চলে আসে এবং জাজিরাতুল আরবকে ছোট ছোট বিভিন্ন টুকরোয় ভাগ হয়ে যায় এই কারনে।
ইংরেজদের সাথে গোপন চুক্তির অংশ হিসেবে আজ পর্যন্ত তার বংশধররা যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছে। কারন তাকে ফিলিস্তিনের পূর্ব দিকে অবস্থিত জর্দানের দায়িত্ব গ্রহণ ও সেখানে জায়নবাদীদের স্বার্থ বাস্তবায়নে কাজ করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। তারা মুসলমান হয়েও ফিলিস্তিনের চতুপার্শ্বে এমন দুর্গ নির্মাণ করে রেখেছে, যেখানে অসহায় মুসলমানদের কোনো ধরণের সহযোগিতার বিপরীতে অত্যাচারী হিংস্র ইহুদিদের স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে।

শরিফ হুসাইন এর মৃত্যুর পর তাঁর এক ছেলে ইরাক ও সিরিয়া অন্য ছেলে জর্দানের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে এদের হাত থেকে ইরাক ও সিরিয়া নিষ্কৃতি পেলেও আজ পর্যন্ত জর্দান এদের অলক্ষুণে হাতে হতে মুক্ত হতে পারেনি।

শরিফ হুসাইন এর ছেলে আবদুল্লাহ বিন হাসান ৩০ বছর (১৯২০-১৯৫০) যাবৎ জর্দানের শাসনকর্তা ছিল। তার শাসনামলেই ইসরাইল প্রতিষ্ঠা লাভ করে, ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়; কিন্তু এতে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। অতঃপর তার প্রপৌত্র হুসাইন বিন তালাল শাসনকার্য পরিচালনা করে; যাকে পৃথিবীবাসী বাদশাহ হুসাইন নামে চিনে। প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর্যন্ত সে জর্ডানকে ইসরাইলের স্বার্থ সংরক্ষণের কেন্দ্রভূমি বানিয়ে রাখে।
তার শাসনামলেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মাধ্যমে বায়তুল মাকদিস ইহুদিদের হাতে সমর্পণ করা হয় এবং বায়তুল মাকদিস দখলকল্পে ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার পরিবর্তে শুধু ইসরাইলকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়াই নয়; বরং ইসরাইলের স্বার্থ সংরক্ষণে নিজের দেশে আমেরিকান সৈন্য স্থাপনাও নির্মাণ করে।
ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সাথে তার সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের অনুমান সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ইসহাক রবিনের মৃত্যুর পর তার কবরে গিয়ে কান্নাকাটি থেকেই অনুমান করা যায়। অথচ ইহুদি ধর্মমতে ইহুদিদের কবরে মুসলমানদের যাওয়ার অনুমতি নেই। অন্যদিকে যখন সে অসুস্থ হয়ে ছিল, ইহুদিদের উপাসনালয়গুলোতে তার জন্য বিশেষভাবে প্রার্থনা করানো হয়েছিল।

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ইহুদিদের অত্যাচারে হিজরত করে আসা ৩ হাজার ফিলিস্তিনিকে তার আদেশেই নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। ফিলিস্তিনিরা সেই মাসকে কালো সেপ্টেম্বর হিসেবে স্মরণ করে। জর্দানে অবস্থিত ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে অধিকৃত ফিলিস্তিনে চলমান হামলা ও প্রতিবাদ সে চরমভাবে দমন করেছিল।আর তার এসব সেবার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মৃত্যুর পর পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের পাঁচজন ইহুদি ও বিভিন্ন খ্রিষ্টান শাসকেরা তার জানাজায় শরিক হয়ে অশুভ যাত্রায় রওনা করিয়ে দেয়।
আর আমরা বর্তমান মুসলিম সম্প্রদায় এখনও আরব নেতাদের দিকে তাকিয়ে আছি, কবে তারা ফিলিস্তিনিদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে।

আরব সরকারগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে গোপনে সহযোগিতা করে আসছে তাতো এখন ওপেন সিক্রেট । ১৯৯০’র দশকে এ লক্ষ্যে ওমান ও কাতারে খোলা হয় ইসরাইলি বাণিজ্য দপ্তর। আরও আগে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে প্রকাশ্যে নতজানুমূলক রাজনৈতিক আপোষ-চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল মিশর ও জর্দান। আর আরব বিশ্বের বাইরে তুরস্কের সঙ্গেও ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রায় সব ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল ও তা এখনও বজায় রয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলের সঙ্গে সৌদি, আমিরাতি এবং ওমান সরকারের মাখামাখি বা ঘনিষ্ঠতাও বিশেষজ্ঞদের চোখে ধরা পড়েছে। ২০১৮ সালে ওমান সফর করে ওমানের তৎকালীন সুলতানের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু।
সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার ইসরাইলের পক্ষে বক্তব্য রেখে ও ইহুদি ধর্ম আর ইসরাইলকে একই অর্থবোধকরূপে দেখিয়ে তার আসল চেহারা প্রকাশ করেছেন। ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় রিয়াদ এবার ‘উম্মে হারুন’ বা ‘হারুনের মা’ নামক একটি টেলিভিশন সিরিয়াল সম্প্রচার শুরু করেছে সৌদি মালিকানাধীন টেলিভিশন এম বি সি-তে। এই সিরিজগুলোর ব্যপারে যারা আরবী জানেন কিন্তু মাদখালী নয় তাদের থেকে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী। আশাকরি এই সিরিয়ালগুলোর ব্যপারে আমাদের সঠিক বিষয়গুলো তুলে ধরবেন।

এই সিরিয়ালে নাকি গত শতকের চল্লিশের দশকে কুয়েতের কোনো কোনো ইহুদির ওপর কোনো কোনো মুসলমানের নির্যাতনের কথিত কাহিনী প্রচার করে পরোক্ষভাবে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্বকে বৈধতা দেয়ার এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা ও তাদেরকে বিতাড়ণের অপরাধগুলোকে ধামাচাপা দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এ ছাড়াও ইসরাইলের অবৈধ অস্তিত্বকে বৈধ ও বাস্তব হিসেবে তুলে ধরা এবং ফিলিস্তিনি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রচার করা হচ্ছে সৌদি কমেডি সিরিজ ‘মাখরাজ-সাত’। এ দুই সিরিজেই ফিলিস্তিনিদের ত্যাগ ও কুরবানিকে নাকি পদদলন করা হয়েছে। আমরা যারা সাধারন শিক্ষিত তাদের এই সব তথ্য জানার সুযোগ কোথায় এই ধরনের অন্যায় সাংস্কৃতিক কার্যকালাপও আমাদের সামনে প্রকাশ করছে না আমাদের ধর্মীয় নেতাগন। কেন?

ফিলিস্তিনের বর্তমান অবস্থা ও ডিল অফ সেঞ্চুরি:
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ইজসরাইলে আমেরিকান অ্যাম্বাসি তেল আবিব থেকে পূর্ব জেরুসালেমে স্থানান্তর এবং পূর্ব জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে ‘ডিল অব সেঞ্চুরি’র গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ট্রাম্পের ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ বাস্তবায়ন হলে যা হবেঃ
১. রাজধানী হিসাবে অবিভক্ত জেরুজালেম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইসরাইলের একক আধিপত্য;
২. পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসকে (জেরুজালেম) দখলদার ইসরায়েলের অবিভক্ত রাজধানী হিসেবে ঘোষণার পাশাপাশি পশ্চিম তীরের ৩০ শতাংশ ভূখণ্ড ইসরায়েলকে দেওয়ার কথা;
৩. পূর্ব জেরুজালেমের উপকণ্ঠে ইসরাইল নির্মিত বিরাট এক দেয়ালের বাইরে ফিলিস্তিনি রাজধানী প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব;
৪. পশ্চিম তীরে ইসরাইলের বসতি স্থাপনের অধিকাংশকেই ইসরাইলের ভূখন্ড হিসাবে স্বীকৃতি; কোন ফিলিস্তিনি শরণার্থী তাদের ভিটেমাটিতে ফিরতে পারবেন না; এবং
৫. ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে’ এ জাতীয় আরো আত্মমর্যাদাহীন শর্ত।

এই ঘোষণাকালে তার পাশে উপস্থিত ছিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। ঘোষণার পর ট্রাম্প বলেছেন, ‘এই পরিকল্পনায় দুই পক্ষ যাতে লাভবান হয় সেই ধরনের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে’। নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘শতাব্দী সেরা এই চুক্তিটি হচ্ছে শতাব্দীর একমাত্র সুযোগ। ইসরাইল এই সুযোগ কখনোই হাতছাড়া করবে না। ইসরাইলের ১৯৪৮ সালের স্বাধীনতা দিবসের মতোই এই দিনটাকে স্মরণে রাখা হবে’।
হামাসের প্রধান হানিয়া মুসলিম ও আরব দেশগুলোর শীর্ষ নেতাদের কাছে পাঠানো বার্তায় বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনি জাতি ট্রাম্পের পরিকল্পনার সহযোগীদের কখনোই ক্ষমা করবে না’। কথিত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’কে সমর্থন দেয়া হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছে ফিলিস্তিনের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ।
ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ তে আরব নেতাদের ভূমিকা আছে কি?
বলা হয়ে থাকে ২০১৫ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে, লোহিত সাগরে বিন সালমান ও সিসিসহ অন্যান্য আরব নেতাদের গোপন বৈঠকের মিশন এটিই ছিল—প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের মনোনয়ন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত হয়েই ট্রাম্প তাঁর ফিলিস্তিন নীতি বাস্তবায়ন শুরু করেন। আরব নেতাদের ইসরাইল ও আমেরিকার সাথে প্রকাশ্য মিত্রতা গড়ে তুলে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের ক্ষমতা কায়েম রাখার পথে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বাধা মনে করা হয় ফিলিস্তিনকে। ফলে ট্রাম্প প্রশাসন শুরু থেকেই ফিলিস্তিন ইস্যুতে চূড়ান্ত কিছু করার ইঙ্গিত দিয়ে আসছিল। ত্রাণ পাঠানো বন্ধ করে দেয়া, পূর্ব জেরুসালেমে অ্যাম্বাসি স্থানান্তর এসবেরই ধারাবাহিকতামাত্র। ‘ডিল অফ দ্য সেঞ্চুরি’র প্রক্রিয়া শুরু করার পরপরই ট্রাম্পের মেয়ে জামাই কুশনার আরব দেশগুলোতে সম্মতি আদায়ের জন্য সফর শুরু করেন। সৌদির বিন সালমান ও মিশরের সিসি বিশেষভাবে এই প্ল্যান বাস্তবায়নে সাহায্যের আশ্বাস দেন। এক পর্যায়ে আমিরাত বা বাহরাইনের মতো দেশগুলোও কুশনারের এই ডিল মেনে নেয়।
বিন সালমান এ ব্যাপারে তাঁর কথা বেশ স্পষ্টভাবেই বলেছেন‘এখনই সময় প্রস্তাবগুলো মেনে নিয়ে আলোচনার টেবিলে আসার। নতুবা ফিলিস্তিনিদের উচিত নিজেদের মুখ এবং মুহুর্মুহু অভিযোগ বন্ধ করা।’ কত বড় দালাল আর নিকৃষ্ট হৃদয়ের অধিকারী হলে উক্ত কথা বলতে পারে। বাহরাইনের অর্থমন্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ইসরাইল থাকবে। আমাদের ইসরাইলের সাথে কোনো সমস্যা নেই।’ এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ আলি আবু নি’মাহ বলেন, ‘এই রেজিমগুলো মাইনরিটি। এরা বংশানুক্রমিক শাসন চালাচ্ছে। এবং বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায়, আমেরিকা ও ইসরাইলকে তারা নিজেদের রক্ষক হিসেবে দেখছে। তাই ইসরাইলের সাথে তারা স্বাভাবিক সম্পর্ক চাচ্ছে। তবে এপথে ফিলিস্তিন বড় বাধা। এই ডিল গালফ স্টেট ও ইসরাইলের মধ্যে, আমেরিকার ঘটকালিতে এক ধরনের ‘পাবলিক ওয়েডিং’, যা ইরানবিরোধী সৌদি-আমেরিকা-ইসরাইলের নেতৃত্বাধীন জোটের কাজকে জোরদার করবে।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই আরব নেতারা ফিলিস্তিনকে বিক্রি করতে চাচ্ছেন। তবে আরবসহ মুসলিম বিশ্বের আপামর জনগণ তাঁদের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। আর এজন্যেই, পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার আগে তাঁরা এটি না প্রকাশ করতে আমেরিকাকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
আমেরিকার এই ডিলের ব্যাপারে আলি আবু নি’মাহ বলেন, ‘ভবিষ্যতে ইসরাইল কোনো চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিলে যেন আমেরিকা তাতে সম্মতি দেয়ার অজুহাত বিশ্বকে দেখাতে পারে, সেজন্যেই এই শান্তিপ্রস্তাব। কারণ আমেরিকা জানে, ফিলিস্তিনিরা এই প্রস্তাব কিছুতেই মেনে নেবে না।
এই হচ্ছে আমাদের আত্মার স্থান, ভালবাসার স্থান গুরুত্পূর্ণ তৃতীয় ধর্মীয় তীর্থস্থান আল আকাসা, মজলুম ফিলিস্তিনবাসী ও আরব নেতাদের গাদ্দারির বর্তমান অবস্থা। উপরোক্ত সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে হলে তা মুসলমান নেতাদেরই করতে হবে এবং সেই ভাবে নিজেদের প্রস্তুতি নিতে হবে। এখন মুসলিম নেতারা কতটুকু প্রস্তুত তা তারাই বলতে পারবে। আমাদের বিশ্বাসী আমজনতা থেকে কিছু বিশ্বাসী শুধু দেখেই যাচ্ছে না কিছু একটা করার জন্যও প্রস্তুতও রয়েছে। নেতারা কতটুকু প্রস্তুত ?
থ্যসূত্রঃ
১. বই: আল আকসার কান্না: ফিলিস্তিনের ইতিহাস: অতিত ও ভবিষ্যতের দর্পনে, আবু লুবাবা শাহ মনসুর, কালান্তর প্রকাশনি)
২. দৈনিক ইনকিলাব
৩. ফাতাহ২৪.কম
৪. পার্সটুডে.কম
লেখাটি সম্পাদনার তারিখ: ২৬ জুন ২০২০

ক্যাটাগরিসমূহ
বিষয় ভিত্তিক আলোচনা

কবি আল মাহমুদ স্মরণ

দেখতে দেখতে একটি বছর পার হয়ে গেলো, আমাদের প্রাণের কবি আল মাহমুদ আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছেন। আজকের এই দিনে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শুক্রবারে, এই ভাষার মাসেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।

যদিও মৃত্যু পরবর্তীও আমরা এই ভাষা সৈনিকের জন্য সম্মানজনক কিছুই করতে পারিনি নিজেদের প্রগতিশীল বাঙালি-সংকৃর্ণমনা, প্রতিক্রিয়াশীল মনভাব হিংসা বশবর্তীতার ও মানবিক দূর্বলতার কারনে অথচ যখন ভাষা আন্দোলন চলছিল তখন তার লিখা ছোট্ট কয়েকটি লাইনের জন্য তার উপর তৎকালীন সরকার থেকে হুলিয়া জারি হয়েছিলো!
ছোট থেকেই সদা চঞ্চল, রোমান্টিক এই কবি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের জন্য দিয়ে গেছেন সাহিত্যের অজস্র শব্দ কণা। সাহিত্য আর প্রকৃতির নেশায় তিনি একাডেমিক পাঠও শেষ করতে পারেননি কিন্তু তাতে কি জাতির জন্য দিয়ে গেছেন বিশাল সাহিত্য কর্ম। যখন কবির লিখিত নিচের ছড়াটা পড়ি তখন শৈশবে হারিয়ে যেতে মন চায়।

আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
^^ ^^
আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।

সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়,
দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেস্তারা উল্টায়।

তখন কেবল ভাবতে থাকি
কেমন করে উড়বো,
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো !
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।

তিনি সবার জন্য লিখতেন, সবার কথা বলতেই তিনি শুধু সাহিত্য চর্চা করেই যান নি, প্রকাশনা শিল্প ও বাজারে অস্থিরতা নিয়েও কথা বলে গেছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা আমাদের প্রকাশনা শিল্প ও উঠতি সাহিত্য বাজারকে ধ্বংসের জন্য কাকে দায়ী করব ? যে দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও শিল্প-সাহিত্য ও সৃজনশীল মানুষের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই, নেই দেশের সাহিত্যের কোনো কদর বা প্রোটেকশন । যে দেশের বইয়ের বাজারে প্রতিবেশী আধিপত্যবাদীরা দৌরাত্ম্য করে, সে দেশে কবি বা কোনো মৌলিক উদ্ভাবক জন্মায় না।
উন্নয়নের কথা যত্রতত্র বললেই যে উন্নয়নের গালগল্প মানুষ বিশ্বাস করবে, এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা।

তিনি আরো বলেন, “সবার আগে সৃজনশীল সাহিত্য । সৃজনশীল সাহিত্যই হলো একটা জাতির মনন ও চিন্তনের স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতার জন্যে লেখকদের আত্মসম্মানবোধের প্রয়োজন । একটি মাত্র আনন্দ পুরস্কারের লোভে যারা দেশের সীমানা তুলে দিয়ে ভারতের সাথে মিশে যেতে চায়, তাদেরও আত্মোপলব্ধির সময় পার হয়ে যায়নি । একটা কথা তাদের মনে রাখা উচিত যে দেশটা ভাগ হয়েছিল বলেই তাদের পক্ষে লেখক-শিল্পী হওয়া সম্ভব হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা এই সুযোগ থেকে চিরকালের জন্য বঞ্চিত । সে দেশে মুসলমান লেখককে মুসলিম হিসেবে কোনো দিন উঠতে দেওয়া হয় না ।
(১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০)

ক্যাটাগরিসমূহ
বই রিভিউ

বই রিভিউ: হযরত হাসান রা. এর জীবন ও শাসন

থ্রিলার থ্রিলার এক আবহের মাঝে এবং অসমাপ্ত উত্তরের মাঝেই পড়া শেষ হলো আল্লামা সাল্লাবির সংকলিত আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রানপ্রিয় বড় নাতি হযরত ফাতেমা রা. ও হযরত আলী রা. এর আদরের বড় সন্তান হযরত হাসান রা. এর জীবন ও শাসন বইটি।
অনেকেই অভিযোগ করে, আমাদের দেশে আহলে বায়েতদের নিয়ে চর্চা কম হয়। নতুন করে ইসলামি সাহিত্যর যে জাগরণ শুরু হয়েছে এবং মানসম্মত বইয়ের অনুবাদ চর্চা শুরু হয়েছে, আশাকরি তাদের অভিযোগ অনেক খানিই কমবে।
বইটি পড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিলো হাসান রা. এর সময় তৎকালীন পরিস্থিতি ও শাহাদাত কালীন ঘটনার বিস্তারিত জানা, কে বা কারা রাসূল সা. এর পিয় নাতিকে বিষপানের মাধ্যমে শাহাদাতের সূধা পান করিয়েছে?

এতোদিন এ সম্পর্কে যতটুকু জানাছিলো তা হলো সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু থেকে যেখানে উল্লেখ্য করা হয়েছে তাকে বিষ পান করিয়েছে তার স্ত্রী! যেবইটি সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে ইসলামি ইতিহাস নিয়ে অধ্যয়ন করার ফলে এখন মনে হচ্ছে এই অভিযোগটি তৎকালীন প্রেক্ষাপটে পুরোপুরিই বেমানান শুধু তাই নয় সৎ নারীর প্রতি কুধারণাও বহি:প্রকাশ হয়েছে যা করতে কুরআন কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
তাহলে কে বা কারা বিষপান করিয়েছে?
উত্তরটি এখনও ধোয়াঁশা রয়ে গেছে ইতিহাসবিদদের কাছে এখনও। সবাই শুধু ধারনার উপর ঘটনা বর্ণনা করে যাচেছ। শীয়া-রাফিযীরা যেমন অভিযোগ করে বিষপানকারীদের ব্যপারে তেমনি আরো অভিযোগ করা যায় তৎকালীন ফেতনা খারেজিদের প্রতি যারা আলী রা.কে হত্যার পর হাসান রা. কেও হত্যাকরারজন্য বারবার প্রচেষ্টা চালিয়েছে, অভিযোগ করা যায় ইবনে সাবার অনুসারীদের উপরও যারা মুয়াবিয়া রা. এর সাথে সন্ধি-স্থাপনে ঘোর বিরোধী ছিলো।
হৃদয়টা কেপে উঠে যখন এই অংশটুকু পড়ি, হাসান রা. যখন কুটিরে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ পর বের হয়ে বললো, আজ এমন বিষ পান করেছি যা অন্যবারের মতো নয়, যেনো আমার কলিজাটা টুকরো হয়ে আলাদা হয়ে গেছে! অর্থাৎ হাসান সা. কে এর আগেও বিষ পান করানো হয়েছিলো কিন্তু তা কাজ করেনি।
অনেক অজানা তথ্যে ভরপুর এই বইটি পড়তে একটুও একঘেয়েমি লাগেনি, আর সাল্লাবির খেলাফত সিরিজ এর আগে শেষ করার ফলে অনেক কিছুই সমন্বয় করতে ও বুঝতে সহজ হয়েছে।
এবার বইটির বাহ্যিক কিছু বর্ণনা বলি, অনুবাদের মান চমৎকার হয়েছে যদিও সিয়ানের সাল্লাবি সিরিজের এটিই প্রথম পড়া বই আমার, অন্যগুলোর প্রশংসাও শুনেছি বিভিন্ন পাঠকদের কাছ থেকে। বইটিতে কিছু বানান ত্রুটি রয়েছে যা চোখে পড়ার মতো না কিন্তু পরবর্তী সংস্করণে আশাকরি সংশোধন করবে। আর পেপার, বাধাঁই, কোয়ালিটি কি বলবো, অসাধারণ হয়েছে। আমিতো এমন হয়েছে বই পড়েছি আবার মাঝে মাঝে বইটির ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য বইটি খুলে নাকের কাছে এনেছি যেখানে অন্যান্য বইগুলো থেকে নাককে দূড়ে সরিয়ে রেখে পড়তে হয়েছে। প্রশংসা করার মতো একটি কাজ হয়েছে। আশাকরি তারা তাদের কাজগুলোকে আরো সুন্দর ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বইয়ের নাম: হযরত হাসান রা. এর জীবন ও শাসন
মূল লেখকের নাম: ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি
অনুবাদকের নাম: হাসান শুয়াইব
প্রকাশনি: সিয়ান পাবলিকেশন লিমিটেড
মূল্য:৫৫০.০০
পৃষ্ঠা: ৩১৮
র‌্যাংকিং: ৪.৬৫/৫

[নোট: সকলের সাথে জ্ঞান শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই আমার বই রিভিউ পোষ্টটি শেয়ার করা। যদি কোনো ভুল-ভ্রান্তি থেকে থাকে দয়া করে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখে ভুলগুলো সংশোধন করে দিবেন যাতে আমি এবং সকলে সঠিকটি জানতে পারি।]

ক্যাটাগরিসমূহ
কবিতা প্রবন্ধ বিষয় ভিত্তিক আলোচনা

কবি এবং সাধারণ মানুষের মধ্য পার্থক্য ও কবিতার গুরুত্ব

কবি এবং সাধারণ মানুষের মধ্য পার্থক্য ও কবিতার গুরুত্ব

যদি প্রশ্ন করা হয় কবির কাজ কী? আল মাহমুদের ভাষায় তাহলে বলতে হয়, কবির প্রধান কাজ হলো তার স্বজাতি ও স্বভাষার নর-নরাীকে কল্পনায় সাঁতার দিতে শেখানো। দেশপ্রেমে, আত্মপ্রেমে, আত্মলিপ্সায় এবং প্রকৃতির মাধুর্যকে উপলব্ধিতে আচ্ছন্ন করে রাখা।

কবি আল মাহমুদ আরো বলেন, “ দার্শনিকরা যদি হঠাৎ বলেন, ‘ দর্শনের কাজ হলো জগতের ব্যাখ্যা নয় জগৎটাকে বদলানো। তবে কবিরা কেন বলতে পারবেনা জগৎটা বদলে যায় কোনো দার্শনিক নিয়মে নয়। কোন ডায়ালেক্টিক পদ্ধতিতে নয়। কোনো শ্রেণী সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় নয়। জগৎটা বদলে যায় মানুষের স্বপ্নে। মানুষের আশায়, মানুষের বিশ্বাসে ও মানবতার ধমের্ । সর্বপরি বিজ্ঞানে ও প্রযু্ক্তিতে। মানুষ হঠাৎ পেয়ে যায়। যেমন একজন কবি ছন্দ, মিল ও উপমা অলৌকিকভাবে একদিন পেয়ে গিয়ে এক অসাধারণ কাব্য সৃষ্টি করে।

যারা কবি, তারা সৃষ্টিগতভাবেই কিছুটা ভাবুক, কল্পনাপ্রবণ ও আবেগী, এটি তাদের স্বভাবধর্ম। কল্পনাপ্রবণ ও আবেগী না হলে কাব্য সৃষ্টি করা যায় না। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে কবিদের প্রতি বিশেষ এক নিয়ামত। যে-কারণে সাধারণ মানুষ শব্দের মাধ্যমে ভাষার যে-বয়ন দিতে পারে না, কবিরা তা পাবেন। এখানেই কবিদের সাথে সাধারণ মানুষের পার্থক্য- এটিকেই বলে কাব্যপ্রতিভা।

কবিতা যেহেতু মানুষের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং ছন্দে ছন্দে অনেক কথাই মনে রাখা সহজ হয়, তাই সালাফে সালেহীন ও উলামায়ে কিরাম কবিতা রচনার প্রতিও মনোযোগী ছিলেন। কবিতার ভেতর দিয়ে মানুষের সামনে পরকালের স্মরণ, দুনিয়োবিমুখতা, জ্ঞানগর্ভ ও প্রজ্ঞপূর্ণ কথামালা এবং সত্য ও সুন্দরের শিক্ষা প্রচারে সচেষ্ট ছিলেন।

তাইতো উমর রা. বলেছেন, “ তোমরা কবিতা সংরক্ষণ করে। কারণ, কবিতা সচ্চরিত্রবান হবার শিক্ষা দেয়। উন্নত আমলের দিশা দেয়। উত্তম কর্মর প্রতির উৎসাহিত করে”।

আমাদের প্রিয় রাসূল সা. ও কবিতার সম্পকের্ বলেছেন, “ নিশ্চয়ই কোনো কোনো কবিতার মধ্যে জ্ঞানের কথাও আছে।”

তাইতো ইমাম বুখারী রহ. উপরোক্ত হাদিসটি যে-অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন, তার শিরোনাম দিয়েছেন এমন ‘যে কবিতা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ,ইলম হাসিল ও কুরআন থেকে বাধা দান করার মতো প্রভাবিত করে, তা নিষিদ্ধ।’

তথ্যসূত্র: গুরাবা, আবূ বকর আল-আজুররী রহ. বই এর অনুবাদ গ্রন্থ এর সম্পাদকীয় ভূমিকা থেকে (পৃষ্ঠা: ২২-২৬)।

মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিবের একটি গজল;

হৃদয়ে অসুখ। ওষুধ কোথাও নেই
স্বাস্থ্যেই আছি। তবু কিছু ভালো নেই।
সারে ক্ষতমুখ, রক্ত তবুও ঝরে।
চাকা থেকে যায়, তবু চাকা থেমে নেই।
অনুরোধ করি, গালিব, কিছু তো বলো।
এই তো গজল- এছড়া কিছু তো নেই।

এই গজলই সব; এই কবিতাই সব; এইই সব – একজন কবির দেবার।
তিনি না বদলাতে পারেন সমাজ;
না চালনা করতে পারেন রাষ্ট্র;
না পোষণ করতে পারেন একটি মানুষকেও;
কিন্তু এই তাঁরই রচনা সমাজের ভিতরে গভীর গোপনে কাজ করে চলে নিঃশব্দে গোপনে;
রাষ্ট্র তার স্বপ্ন এবং স্থিতি ফিরে পায় তাঁরই রচনায়, মানুষ পুনরুত্থিত হয়।

কবির কাছে শব্দের গুরুত্ব কি ?

কবি জানেন, এককটি শব্দ হচেছ সেই ভাষাভাষী জাতির ইতিহাস-সভ্যতা-সংস্কৃতির সাঁটলিপি;
কৃষ্ণচূড়া এ বাংলাদেশে শুধু ফুল নয় ভাষা আন্দোলনকে ধরে;
রক্ত এ বাংলাদেশে একাত্তরকে ধারণ করে;
গায়ে হলুদ শরীরে হলুদ লেপন নয়, বিয়ের খবরটা পৌঁছে দেয়।
এবং কবি জানেন, শব্দ আসলে চিত্র; মূর্ত বিমূর্ত সকল শব্দই যে চিত্র তা যে-কোনো শব্দের মূল বিশ্লেষণ করলেই বেরিয়ে আসবে। শব্দের ওই অনুভব, ওই ধ্বনিসঙ্গীত, ওই সাঁটলিপি, ওই চিত্রই – কবিতা লিখতে গিয়ে যদি শব্দ সন্ধানই করেন কবি তো ওই সকলই সন্ধান করনে এবং তাঁর পঙক্তিতে স্থাপন করেন।

তথ্যসূত্র:

– মার্জিনে মন্তব্য, সৈয়দ শামসূল হক,

– আবুল কাশেম ফজলুল হক, নতুন এক মাত্রা(ম্যাগাজিন), ঈদ সংখ্যা-২০১৯, ।
(৯ জুলাই ২০১৯)

ক্যাটাগরিসমূহ
কবিতা

যোদ্ধাকার!

চারদিকে চলছে এখন রাজাকারের গুনগান
প্রকাশ হয়ে পড়েছে তাদের, ৭১ এর অবদান।

খুজতে খুজতে হয়রান সব, কে যোদ্ধা কে রাজাকার
জনগনের ৬০ কোটি গায়েব, দূর্নীতিতে সব একাকার!

রক্তে রক্তে জর্জরিত, হয়েছিলো দেশ স্বাধীন
দেশে নাকি চলছে লুট, বললে হবে পরাধীন।

পাকি ভাতা খেয়ে যারা হয়েছিলো সব রাজাকার
সময়ের সাথে রুপ পাল্টিয়ে হয়েছে সব যোদ্ধাকার!

মুক্তি মুক্তি মুক্তি এখন সাজে তারা মুক্তিযোদ্ধা
যুদ্ধে যারা হলো ক্ষত, তাদের বুকে বড়ই ব্যথা।

আমরা যারা এ প্রজন্ম, চিনবো তাদের ক্যামনে
বোঝার শুধু একটাই উপায়, চালচলন আর কর্মে!
হউক না সে রায় বাহাদুর, ধর্মে বা বর্ণে।
(১৮-১২-২০১৯)

ক্যাটাগরিসমূহ
বিষয় ভিত্তিক আলোচনা

কোরআনের চাহিদানুযায়ী নিজের পরিবর্তন সাধনের দৃঢ় সংকল্পঃ

কোরআন যেভাবে আমাদের তৈরী করতে চায় সেভাবে পড়বো নাকি যেভাবে আমরা আমাদের মনমতো চলতে চাই সেভাবে কোরআন পাঠ করবো ?


কোরআন অধ্যয়নের গুরুত্বর উপর চমৎকার একটি লেখা আমি শেয়ার করছি কোরআন পড়তে আগ্রহী পাঠকদের জানানোর উদ্যশ্যে এবং নিজেকেও স্বরণ ও সতর্ক করিয়ে দেওয়ার জন্য ।


কোরআনের চাহিদানুযায়ী নিজের পরিবর্তন সাধনের দৃঢ় সংকল্পঃ


# কোরআনে হাকীম থেকে যথাযথ উপকার লাভের জন্য মনে কোরআনের চাহিদা অনুসারে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীন দিক থেকে নিজেকে পরিবর্তন করার সুদৃঢ় সংকল্প বিদ্যমান থাকতে হবে।
# কোন লোক যখন কোরআনকে গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করে, তখন পদে পদেই সে অনুভব করে, কোরআনের চাহিদা এবং দাবী তার স্থুল ইচ্ছা-আকাঙ্খার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
# সে দেখতে পায়, তার পূর্বকল্পিত ধ্যান-ধারণারগুলোও কোরআনের পার্থক্যপূর্ণ আর তার আচার –আচরণও কোরআন কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা বর্হিভূত।
# তখন সে নিজের বাহ্যিক দিকটিকেও কোরআন থেকে অনেক দূরে দেখতে পায় এবং তার অভ্যন্তরকেও কোরআনের পরিপন্থী বলে অনুভব করে।
এহেন বিরোধ-বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হবার পর একজন দৃঢ় সংকল্প সত্যান্বেষী ব্যক্তি এ সিদ্ধান্তই গ্রহণ করে যে, যাই ঘটুক না কেন, আমি নিজেকে কোরআনের চাহিদা মোতাবেক অবশ্যই গঠন করে নেব। সুতরাং সে চরম ত্যাগ স্বীকার করে যেকোন রকম বিপদাপদ সহ্য করে নিজেকে কোরআনের চাহিদা অনুযায়ী গঠন করতে চেষ্টা করে এবং শেষ পর্যন্ত নিজেকে কোরআনের ছাঁচে গঠন করতে সমর্থও হয়।
কিন্তু যারা দৃঢ় সংকল্প নয় তারা সে ব্যবধান দূর করার সাহসই করেতে পারে না, যা তারা নিজের এবং কোরআনের মধ্যে প্রতিবন্ধক দেখতে পায়। তারা অনুভব করে:
১. যদি আমি নিজের আকীদা বিশ্বাসসমূহকে কোরআন অনুযায়ী তৈরী করতে চেষ্টা করি, তাহলে আমাকে মানসিক এবং স্নায়ুবিক দিকে থেকে পূনর্বার জন্মগ্রহণ করতে হবে;
২. সে দেখতে পায়, আমি যদি নিজের চরিত্র ও কার্যকলাপকে কোরআনের ছাঁচে গড়তে চেষ্টা করি, তাহলে আমার নিজস্ব পরিবেশ আমার জন্য সম্পূর্ণভাবে অপরিচিত হয়ে পড়বে;
৩. তার মনে এমন ধারণারও সৃষ্টি হয় যে, আামি যদি নিজেকে এসব উদ্দেশ্য সাধনে পরিব্যস্ত করে ফেলি, যা কোরআন আমার কাছে দাবী করে, তাহলে আমি যে আনন্দ ও মুনাফা লাভ করছি, তা লাভ করা তো দূরের কথা, জেল-ফাঁসির মত সুকঠিন সাজা ভোগ করাও বিচিত্র নয়;
৪. সে স্পষ্ট দেখতে পায়, যদি আমার জীবিকার উপকরণগুলোকে কোরআন কর্তৃক নির্ধারিত হালাল-হারামের কষ্টি পাথরে যাচাই করি, তাহলে আমি এখন যে আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসে দিন কাটাচ্ছি, তা থেকে বঞ্চিত হয়ে হয়ত রোজ-রোজকার জীবিকা সংগ্রহের জন্যই চিন্তান্বিত হয়ে পড়তে হবে।

এসব আশঙ্কার মোকবিলায় দৃঢ়তা অবলম্বন করা এবং এগুলোর মোকাবিলা করার জন্য সুকঠিন মনোবল সঞ্চয় করা যার তার কাজ নয়। শুধু মাত্র দুঃসাহসী ব্যক্তিরাই এহেন কঠিন ঘাঁটি পার হতে পারে। দুর্বল স্নায়ুর লোকেরা এখানে এসেই মনোবল হারিয়ে ফেলে; গতি পরিবর্তন করে নেয়।


আর একটি গ্রুপ আছে, যারা নিজেদের দুর্বলতা গোপন করার পক্ষপাতী নয়; তারা এই বলে নিজেদের অনুসৃত পথে্ চলতে শুরু করে যে, কোরআনের নির্দেশিত পথ নিঃসন্দেহে একান্ত যথার্থ; কিন্তু এত চলা অতি কঠিন। কাজেই আমরা সে পথেই চলব, আমাদের রিপু যে পথে নিয়ে যায়। কিন্তু যারা নিজেদের দুর্বলতাকে সংকল্প এবং প্রতারণাকে বিশ্বাস হিসেবে উপস্থাপন করতে আগ্রহী, তারা নিজেদের এই আগ্রহ বিভিন্ন উপায়ে পূর্ণ করে থাকে । কেউ কেউ অপারগতা এবং বাধ্যতার ছলে নিজেদের জন্য অবৈধকে বৈধ এবং হারামকে হালাল করে নেয়। কেউ কেউ নানারুপ ছলচাতুরী ও অপব্যখ্যার মাধ্যমে মিথ্যার ওপর সত্যের রং লাগিয়ে নেয়। আর কেউ কেউ সময়ের চাহিদা কিংবা আপাত সুবিধা খুঁজতে চেষ্টা করে। কেউ কেউ কালামুল্লাহর এমন অপব্যাখ্যার চেষ্টাও করে যেমন ইহুদীরা করেছিলো। আর অনেকে কুফর ও ঈমানের মাঝামাঝি একটা পথ বের করে নিতে সচেষ্ট হয়। অর্থাৎ কোরআনের যে অংশটুকু তাদের নিজেদের মনোমত বলে মনে হয়, তারই অনুসরণ করে আর যে অংশটুকু তাদের মনোমত নয় তা বর্জন করে।
এ সমস্ত পথই শয়তান কর্তৃক উদ্ভাবিত। এর যেকোন পথই মানুষ অবলম্বন করবে, সে পথ সরাসরি ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। কৃতকার্যতা এবং কল্যাণের পথ একমাত্র এই যে, মানুষ নিজেকে কোরআনের ছাঁচে ঢেলে নেয়ার সাহস করে সে জন্য যেকোন রকম ত্যাগের জন্য উদ্বুদ্ধ হবে। কিছুকাল আল্লাহর তরফ থেকে এ পথের পরীক্ষা চলতে থাকে। কিন্তু যদি এতে দৃঢ়তা অবলম্বন করতে চেষ্টা করে, তাহলে তার জন্য সৌভাগ্য ও কৃতকার্যতার পথ খুলতে শুরু করে, একটি দরজা যদি বন্ধ হয়ে যায়, আল্লাহ তার জন্য অন্য আরেকটি দরজা খুলে দেন। একটি পরিবেশ থেকে যদি সে উৎক্ষিপ্ত হয়, তাহলে অন্য একটি তাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে আসে। কোন এলাকা যদি তাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে, তাহলে অন্য এলাকা তার জন্য কোন পেতে দেয়।

তথ্যসূত্র: কোরআন গবেষণার মূলনীতি (পৃষ্ঠা: ৪-৬ ), লেখক: মাওলানা আমীন আহসান এসলাহী, অনুবাদক: মাওলানা সৈয়্যদ মোহাম্মদ জহীরুল হক, রশীদ বুক হাউস,, ৬, প্যারীদাস রোড, ঢাকা-১১০০।

ক্যাটাগরিসমূহ
বই রিভিউ বিষয় ভিত্তিক আলোচনা

বৈধ ব্যবসা না-কি আসমানী আযাব!

আযানের সাথে সাথেই আজ ছেলেকে নিয়ে এশার সালাতে উপস্থিত হয়ে প্রথম কাতারের এক পার্শ্বে অবস্থান করেছিলাম। সালাত শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট পূর্বে মাওলানা আব্দুল খালেক এর “আসমানী আযাব কেন”? বইটি দেখে কৌতুহল জাগলো। ছোট্ট চটি আকারের এই বইটি বাংলাদেশে ইসলামিক সেন্টার থেকে মূদ্রিত হয়েছে । পুরানো ছেড়াফাটা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনার প্রতি আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হওয়ায় সাথে সাথে মোবাইলে  ছবি তুলে নিলাম, সালাত শেষে নিরিবিলি এই বিষয় নিয়ে ভাবার জন্য এবং দু-একটি তাফসীর দেখে পুরো আলোচনা অনুধাবন করার জন্য যা নিম্মে পাঠকদের সাথে শেয়ার করছি।

হযরত শুয়াইব আ. এর জাতির অধিকাংশই ছিল ব্যবসায়ী । তারা ক্রয় করার সময় অপর পক্ষকে ঠকিয়ে ওজনে বেশী মাল নেয়া এবং বিক্রীর সময় খরিদ্দারকে ওজনে কম দেয়ায় পারদর্শী ছিল। তাঁর জাতির লোকেরা সাধারণত মাপে কম দিতো এবং মানুষকে ঠকাতো। অর্থাৎ লেনদেনের সময় মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে কম দেয়া এদের নেশা ও পেশায় পরিণত হয়েছিলো। 

এ এমন এক জঘন্য খাসালাত ও রোগ ছিল , যা অন্তরের পরিচ্ছন্নতা এবং বাস্তব লেনদেন উভয়টাকেই দলিত মথিত করে দেয়, যেমন করে নষ্ট করে মানুষের প্রতি সৌজন্যবোধ এবং ভদ্রতা জ্ঞানকে। 

এ যালেম জাতি বাস করতো এমন সুবিধাজনক এলাকায় যে, সেখান থেকে আরব উপদ্বীপের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে গমনকারী বানিজ্য কাফেলাগুলোকে অতিক্রম করতেই হতো। অর্থাৎ সকল এলাকার বাণিজ্য যাত্রীদের এটাই ছিলো যাতায়াতের একমাত্র পথ। এ সুযোগে তাদের ওপর এ এলাকাবাসী প্রাধান্য বিস্তার করতো এবং জবরদস্তী করে তাদেরকে বাধ্য করতো ওদের শর্তেেই লেনদেন করতে। 

উপরোক্ত চিত্রটি  কী আমাদের নিকট স্পষ্ট হচ্ছে না? বর্তমানেও আমরা দেখছি যে, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে জনগনকে কষ্টে ফেলছে।

আল্লাহর নবী উপরোক্ত রোগ থেকে মু্ক্ত করতে তাদেরকে ওসব নিকৃষ্ট কাজগুলো পরিত্যাগ করার আহ্বান জানান। হযরত শুয়াইব আ. তার জাতির মধ্যে নৈতিক রোগ দূর করার লক্ষ্যে তাদের ডেকে বলছিলেন, 

“ আর হে আমার সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা! যথাযথ ইনসাফ সহকারে মাপো ও ওজন করো এবং লোকদেরকে তাদের প্রাপ্য সামগ্রী কম দিয়ো না। আর পৃথিবীতে বিপর্যয় ছড়িয়ে বেড়িয়ো না।(হুদ- ৮৫)”

কিন্তু তাঁর গুমরাহ জাতি, তাঁকে এর জবাবে উত্তর দিয়েছিলো, 

 “হে শো’আয়েব! তোমার অনেক কথাই তো আমরা বুঝতে পারি না(*১) আর আমরা দেখছি তুমি আমাদের মধ্যে একজন দুর্বল ব্যক্তি। তোমার ভ্রাতৃগোষ্ঠী না থাকলে আমরা কবেই তোমাকে পাথর নিক্ষেপে মেরে ফেলতাম। আমাদের ওপর প্রবল হবার মতো ক্ষমতা তোমার নেই(*২)। (সূরা হুদ-৯১)”

শুয়াইব আ. এর জাতির অন্তর এতটাই পাথর হয়ে গিয়েছিল যে, তারা বুঝতেই পারতো না যে, ব্যবসা বানিজ্যে একটু হাত সাফাই না করলে ব্যবসা কী করে চলতে পারে। তারা মনে করতো ওটাও ব্যবসায়ের একটা দক্ষতা। তাই ওসব পরিত্যাগ করার অর্থ হল ব্যবসায়ে মুনাফার পরিমাণ কমে যাওয়া। এজন্য তারা আল্লাহর নবীকে বলতো যে, তাঁর কথাবার্তা উদ্ভট মনে করছে এবং এসব নীতি বাক্য উচ্চারণ ও প্রতিপালনের ফলেই হযরত শুয়াইব আ. অর্থনৈতিক দিক থেকে দরিদ্র ও দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর স্বগোত্রীয়দের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ছিলে বিধায় তাঁর উপর আক্রমন করতে সাহস করেনি। অন্যথায় তারা সদুপদেশ দেওয়ার প্রতিদানে আল্লাহর নবীকে পাথর মেরে হত্যা করতেও প্রস্তুত ছিল।

অথচ হযরত শো’আয়েব কোন বিদেশী ভাষায় কথা বলছিলেন না। অথবা তাঁর কথা কঠিন, সূক্ষ্ম বা জটিলও ছিল না। কথা সবই সোজা ও পরিষ্কার ছিল। সেখানকার প্রচলিত ভাষায়ই কথা বলা হতো। কিন্তু তাদের মানসিক কাঠামো এত বেশী বেঁকে গিয়েছিল যে, হযরত শো’য়েব আ. এর সোজা সরল কথাবার্তা তার মধ্যে কোন প্রকারেই প্রবেশ করতে পারতো না। 

একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, যারা অন্ধপ্রীতি, বিদ্বেষ ও গোষ্ঠী স্বার্থ দোষে দুষ্ট হয় এবং প্রবৃত্তির লালসার পূজা করার ক্ষেত্রে একগুঁয়েমির নীতি অবলম্বন করে, আবার এ সঙ্গে কোন বিশেষ চিন্তাধারার ওপর অনড় হয়ে বসে থাকে তারা তো প্রথমত এমন কোন কথা শুনতেই পারে না যা তাদের চিন্তাধারা থেকে ভিন্নতর আর যদি কখনো শুনেই নিয়ে থাকে তাহলে তারা বুঝতেই পারে না যে, এসব আবার কেমন ধারার কথা!

আবার এই বিষয়গুলো অধ্যয়ণ করার সময় একথা অবশ্যি সামনে থাকা দরকার যে, এ আয়াতগুলো যখন নাযিল হয় তখন হুবহু একই রকম অবস্থা মক্কাতেও বিরাজ করছিল। সে সময় কুরাইশরাও একইভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রক্ত পিপাসু হয়ে উঠেছিল। তারা তাঁর জীবননাশ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু শুধু বনী হাশেম তাঁর পেছনে ছিল বলেই তাঁর গায়ে হাত দিতে ভয় পাচ্ছিল। কাজেই হযরত শো’য়েব আ.  ও তাঁর জাতির এ ঘটনাকে যথাযথভাবে কুরাইশ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।

এই রোগ থেকে মুক্তির উপায় কী?

লেনদেনের সময় মানুষকে ঠকানো ও কষ্ট দেয়ার এ দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা হতে পারে একমাত্র আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার ওপর অবিচল বিশ্বাসের ওপর। তাঁর যাবতীয় হুকুম পালনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে বাস্তব আনুগত্য, আমানতের হক আদায়ের অনুভূতি, লেনদেনের পরিচ্ছন্নতা, ব্যবসায়ী সততা ও লোকদের সাথে ভদ্রতাপূর্ণ আচরণ। ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের সাথে লেনদেন কালে একমাত্র আল্লাহভীতিই তাদের গোপন চুক্তিকে ঠেকাতে পারে। এ পরিত্র ঈমানই মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী বানানোর গ্যারান্টি দেয়, নিশ্চয়তা বিধান করে পৃথিবীর মানুষের মধ্যে সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার। 

অবশ্যই সুষ্ঠু লেনদেন ও চারিত্রিক বলিষ্ঠতার পেছনে কোন মযবুত ভিত্তি থাকতে হবে, যা নিত্য পরিবর্তনশীল কোন মনমানসিকতার সাথে জড়িত নয়, আর তা হচ্ছে ইসলাম। আর পূর্ণাঙ্গ এ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বুনিয়াদীভাবে মানব নির্মিত যে কোন সামাজিক ও নৈতিক ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষের চিন্তা-প্রসূত ও মনগড়া ধারণা, অনুমানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ব্যবস্থায় তাদের বাহ্যিক সুযোগ সুবিধার দিকেই খেয়াল দেওয়া হয় মাত্র!

আর যখন ইসলামের স্থায়ী ভিত্তির ওপর কোন নীতি নৈতিকতা গড়ে ওঠে, তখন সেখানে (সাময়িক ও ) উপস্থিত সুযোগ সুবিধা ও বস্তুগত স্বার্থ গৌণ হয়ে যায় এব ইসলামী অনুভূতি ও আল্লাহর ভয়ের প্রভাবে গোটা পরিবেশের মধ্যে দেখা দেয় অভাবনীয় পরিবর্তন। মানুষ কৃষি ক্ষেত্রে কাজ করুক, পশু চড়াক, বা শিল্প কারখানার মধ্যে যেখানেই যখন কাজ করুক না কেন, আল্লাহর ভয় এবং তাঁর কাছে জওয়াবদিহি করার চিন্তা না থাকলে তাদের লেনদেন কোন স্থায়ী নীতি নৈতিকার দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পাদিত হওয়া সম্ভব না। 

যখন জীবনের সকল বিষয়কে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করা হবে এবং সকল কাজের পেছনে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা করবে, তাঁর কাছেই প্রতিদান পাওয়া আকাংখা করবে এবং তাঁর আযাব থেকে বাঁচার প্রেরণা কাজ করবে তখন মানুষে মানুষে গড়ে উঠবে পারস্পরিক সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও শুভেচ্ছা।

আর নীতি নৈতিকতা সম্পর্কিত মানুষের তৈরী বিভিন্ন মতবাদের যতোই প্রশংসা করা হোক না কেন, বাস্তব জীবনে ইসলামী নৈতিকার মোকাবেলায় অর্থনৈতিক আদান প্রদান ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সে সব ব্যর্থ ও নিষ্ফল বলে প্রমানিত হবে।

 তথ্য সহায়তা: তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন ও তাফহীমুল কুরআন এর সূরা হুদ থেকে।

তারিখ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

ক্যাটাগরিসমূহ
বই রিভিউ

কালাম দর্শন

কালামদর্শন

সুপরিচিত লেখক, সাহিত্যিক, দার্শনিক মূসা আল হাফিজের “কালামদর্শন” বইটি পড়া শুরু করেছিলাম ২০২১ এর অক্টোবর মাসে এবং তখন শেয়ারও করেছিলাম কিন্তু সমাপ্ত করতে পেরেছি মাত্র গতকাল ০৪ মার্চ ২০২২ ইং তারিখে। একটা লম্বা সময়ের পরিভ্রমন কালামদর্শনে।
বইটি শেষ করতে এতো দীর্ঘ সময় লাগার কারন হচ্ছে এই এমনই একটি জটিল শাস্ত্র যা অনেক জ্ঞানীগুনীর এই বিষয় থেকে এড়িয়ে চলেন সেখানে আমার মতো সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন পাঠকের জন্য কতটা সহজবোধ্য হতে পারে তা ভাববার বিষয়।

বছর খানেক ধরে ফেবুর পাতায় কালাম শাস্ত্র, দর্শন, আসয়ারি, আশয়ারি-মাতুরিদি ইত্যাদি মতবাদ বা দল নিয়ে নানান টাইপের বাহাস চোখে পড়ছিল । আমি নিজেরও দ্বিধা দ্বন্দে ছিলাম যে আমি কাদের দলে পড়ি 😊 , টুকটাক যতটুকু ধর্ম পালনের চেস্টা করি তাও কি বাতিলের পর্যায়ে পড়ছে কি-না। এক্ষেত্রে হাইব্রিড দল যদি বলা হয় তাহলে সেই দলেই সম্ভবত পড়বো, এখান থেকে একটু ওখান থেকে একটু ….. 😊 ।

বুঝের জটিলতার কারনে দর্শন নিয়ে আমার পাঠ অভিজ্ঞতা খুবেই স্বল্প এবং এ সংক্রান্ত প্রথম বই পড়া হয়েছিল মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (রহ) এর ”ইসলামের ইতিহাস দর্শন” নামক বইটি। ছাত্রজীবনে প্রথমবার কী পড়েছিলাম তা কিছুই বুঝি নাই। পরবতীর্ আরো ১৩ বছর পর বইটি হঠাৎই চোখে পড়ায় আবার পড়া শুরু করেছিলাম এবং এখন মনে হচ্ছে বইটি আবারও পড়তে হবে।

এ সংক্রান্ত দ্বিতীয় যে বইটি পড়া হয়েছিল সেটা হলো মুহাম্মদ আবদুল হালিম এর ”মুসলিম দর্শন : চেতনা ও প্রবাহ” নামক চমৎকার একটি বই। যদিও শুরুর দিকে সহজ মনে হলেও অধের্ কের বেশী পড়া পর আর শেষ করতে পারি নি আমার বুঝ অক্ষমতার কারনে সম্ভবত।

দর্শন সংক্রান্ত তৃতীয় বইটি পড়া হয়েছে জি এইচ হাবীব অনূদিত ইয়স্তেন গার্ডার এর সোফির জগৎ নামক অসাধারণ একটি বই যেখানে শুধুমাত্র ইউরোপীয় দার্শনিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে গল্পের মাধ্যমে। পাঠ অভিজ্ঞতা অসাধারণ ছিল এবং এর রিভিউ দেয়ার সুযোগও হয়েছিল যদিও এখন মনে হচ্ছে বইটি আবার পড়া দরকার।

এই বইটি সমাপ্ত করার পরও মনে হলো আমি কিছুই বুঝি নাই । সবই মাথার উপর দিয়ে গেছে। তবে কালাম শ্রাস্ত্রের প্রাথমিক জ্ঞান হিসেবে যে এই বইটি পরবর্তীতে আমার উপকার হবে সেটা অনুধাবন করতে পারছি যদি ধারাবাহিক চর্চা ধরে রাখতে পারি। বইটি থেকে কিছু পাঠ শেয়ার করছি পাঠকদের বুঝার সুবিধার্থে।

ইসিলামি দর্শনের মূল উৎস কী?
ইসলামি দর্শনের মূল উতস হলো কুরআন। পবিত্র কুরআন থেকেই মুসলমানরা দার্শনিক চিন্তাচেতনার অনুপ্রেরণা ও খোরাক পেয়েছেন। যদিও অনেক প্রাচ্যবিদ ইসলাম সম্পর্কে অভিযোগ করে, গ্রীকভাষায় অনূদিত গ্রন্থাবলীর উপর ভর করে নাকি মুসলিম দর্শন যাত্রা শুরু হয়, আবার কেউ কেউ বলেন ইসলামি দর্শন আ্যারিস্টটলের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া কিছুই নয়, এতে শুধু গ্রীক চিন্তাভাবনাকেই আরবি ভাষায় লেখা হয়েছে।

রাসূল সা. পরবর্তী মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের প্রথম সারির ব্যক্তিদের অন্যতম হলেন রাসূল সা. এর জামাতা হযরত আলী রা. যার প্রকাশ পেয়েছে হযরত আলী রা. এর পত্র, খুতবা ও উপদেশবাণী যা ছিলো দার্শনিকতায় ঋদ্ধ এবং এ মুল্যবান উপদেশগুলোর অনেকাংশই পাওয়া যাবে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক আলোচনা সমৃদ্ধ বই নাহজুল বালাগাহ’ তে। ‘নাহজুল বালাগাহ’ গ্রন্থে দার্শনিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় আলোচিত অনেক বিষয় যেমন, আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, আল্লাহর বৈশিষ্ট্য ও স্বত্তারসাথে বৈশিষ্ট্যর সম্পর্ক, সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক, বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে, না কি অনাদি, অস্তিত্ব জগতের বিভিন্ন স্তর বোধগম্য করে বুঝানোহয়েছে (পৃ:৭৪)
আফসোসের বিষয় হলো এই গ্রন্থটি শিয়াদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিতাব হওয়ার কারনে সুন্নিদের কাছে অস্পৃশ্য হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
মিথ্যার ভয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে কতটুকু সঠিক জ্ঞান অর্জন সম্ভব তা আল্লাহই ভালো জানেন কিন্তু আমরা যারা সাধারণ, চোখের সামনে জ্ঞান বহরের প্রমানতো দেখছি।

এই ’নাহজুল বালাগাহ’ বইটি গত দুবছর আগে সংগ্রহ করা হলেও ইতিহাসের স্পর্শকাতর বিষয়ে অজ্ঞতার কারনে বইটি পড়া থেকে বিরত ছিলাম এবং অপেক্ষায় ছিলাম যে তাহকিক সহকারে কেউ বইটি জ্ঞাণপিয়াষু ও হেদায়েত পেতে আগ্রহী মুসলমানদের জন্য নিয়ে আসবে। সে আশাটাই বৃথা! শুধু তাই নয় দুঃখ জনক ব্যাপার হলো রাসূল সা. এর বংশধরদের প্রতি যারা সারাজীবন বিদ্বেষ পোষণ করে গেছেন রাজনৈতিক কারনে তাদের তোষামুদি নিয়ে বড় বড় বই বেরুচ্ছে। হেদায়েত আসবে কোথা থেকে।

দার্শনিক মুসা আল হাফিজের প্রতি আবারও সশ্রদ্ধা প্রকাশ করছি বইটি সম্পর্কে সামান্য কিছু হলেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এবং বইটি পড়ার প্রতি সাহস সৃষ্টি করার কারনে।

ইসলামি দর্শন ও গ্রিক দর্শনের মধ্যে পার্থক্য কী?
গ্রিক দর্শনের শেষ সীমা মানুষের স্বজ্ঞা। সে অভিজ্ঞতা, জ্ঞান -প্রজ্ঞা ও স্বজ্ঞা দিয়ে বিচার করে সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু ইসলামি জ্ঞানের উৎস হচ্ছে ওহী বা আল কুরআন থেকে তার আগমন। অতএব ইসলামী দর্শন যা দেখে, গ্রিক বা আধুনিক পশ্চিমা দর্শন তার অনেক কিছুই দেখে না। দেখার সামর্থ নেই।

গ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো, মানুষ যে ভালো মন্দ বিচার করতে পারে, তা কেবল যুক্তি দিয়েই। মানুষ ছাড়া অন্য কেউ যুক্তপ্রয়োগ করতে পারে না, অতএব ভালো মন্দ বিচার করতে পারে না। ফলে মানুষ সেরা। অন্য প্রাণি অধম।

দার্শনিক আল-ফারাবি বলেছেন, শুধু যুক্তি বুদ্ধি দিয়েই মানুষ সেরা হতে পারে না। বরং মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মূলে আছে বিবেগগুণ। বিবেগ না থাকলে যুক্তি পাশবিক পন্থা অবলম্বন করতেই পারে। যুক্তির ভালো মন্দ যাচাই করবে জাগ্রত, সবল, স্বচ্ছ বিবেগ। (পৃঃ৭৯)

ইলমে কালামের মূল কাজ কী?
ইলমে কালামের একটি কাজ হলো বিভিন্ন দর্শন ও চিন্তাধারার অভিঘাত থেকে ইসলামি বিশ্বাসের সুরক্ষা। এটি ঈমানের জায়গা থেকে কুফুরের সাথে লড়াই করে, ধর্মের জায়গা থেকে ধর্মহীনতার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং বিশ্বাসের জায়গা থেকে অবিশ্বাসের মোকাবেলা করে। (পৃঃ৮২)

ইসলামি ধর্মতত্ত্বের এমন কোন দিক ছিলো না, যার জন্য অন্য সভ্যতার উপাদান লাগবে। ইসলাম আপন জ্ঞানতত্ত্ব, জ্ঞানকাণ্ড ও জ্ঞানকর্মের স্রোত বইয়ে দিয়েছিলো আপন শক্তিতে।

ইসলামি আকিদার প্রতিটি দিককে অকাট্য প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যে যুগে যে মাত্রার সন্দেহ সংশয় ও আপত্তি তৈরি হয়, সেই যুগে সেই এলাকার অধিকতর মাত্রার শক্তিশালী জবাব দিয়ে এই আকিদাকে প্রমাণ করতে হবে।

বইটির বিষয়বস্তু অতোটা সহজ হবে না যতটা ভেবেছিলাম যখন বইটি পড়া শুরু করার পর যখন এগুতে থাকি তখনই অনুধাবন করতে থাকি। যের-যবর ছাড়া আরবী বাক্যগুলো যে আমাকে বহুত ভুগিয়েছে। নূর একাডেমীতে আরবী শেখায় বিরতি দেয়ার খেসারত এখন বুঝতে পারছি, আবার যে নিজেরক আরবী শেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবো বুঝতে পারছি না অথচ এই মূহুর্তে আরবী শিক্ষাটা সবচেয়ে বেশী জরুরী। কারন ইসলামের মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো অনুধাবন করতে আরবী সাহিত্যে জানার বিকল্প নেই এবং শুধু অনুবাদ পড়ে প্রকৃত অর্থ মর্মউদ্ধার করা অনেক সময় জটিল হয়ে পরে অনেকক্ষেত্রেই অনুবাদকের সাথে মূল লেখকের ভাবনার বৈপরীত্যর কারণে।

লেখক এই বইটিতে প্রথমেই শুরু করেছেন কালাম শাস্ত্র পরিচিতি নিয়ে। তারপর একে একে কালামদর্শন: সমালোচনায় একনজর, কালাম দর্শন বনাম অন্যান্য দর্শন, আধুনিক কালামদর্শন, বিচিত্র ফিরকার উদ্ভব, শিয়াবাদ, খারেজী মতবাদ, মুরজিয়াবাদ, মুতাজিলাবাদ, আসারী-সালাফী ধারার, আশআরী ধারা, মাতুরিদী ধারা, আশআরী-মাতুরিদী ভিন্নমত, এবং এসব দর্শনের আলোচনায় সেইসব অগ্রপথিকদের পরিচিতি নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা নিয়ে এসেছেন সংক্ষিপ্ত আকারে।

বইটি পড়া শেষ করেছি কিন্তু বিস্তারিত রিভিউ করতে পারছিনা, দর্শন ও ধর্ম সংক্রান্ত অজ্ঞতার কারনে। ইসলামি দর্শন নিয়ে আগ্রহী পাঠকদের কাছে বইটির সামান্য পরিচয় তুলে ধরার জন্য আমার এত প্যাচাল।
যারা বইটি সংগ্রহ করতে ইচ্ছুক তারা বই মেলাতে যেয়ে সংগ্রহ করে নিতে পারেন।

বইয়ের নাম: কালামদর্শন
লেখকের নাম: মুসা আল হাফিজ
প্রকাশনির নাম: শোভা প্রকাশন
মূদ্রন মূল্য: ৫৫০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৪১৬

তারিখঃ
বাংলা- ২০ ফাল্গুন ১৪২৮.
আরবি- ০১ শাবান, ১৪৪৩.
ইংরাজি- ০৫ মার্চ, ২০২২ ইং।

ক্যাটাগরিসমূহ
Uncategorized

আমার স্বদেশ ভাবনা

কিছু মানুষ মরে যায়

রেখে যায় তাঁর কর্ম

তা দেখেই বুঝতে পারি

তার জীবন ও ধর্ম

জীবন ঘনিষ্ট দার্শনিক ও চিন্তাবিদ এবনে গোলাম সামাদ। যিনি এই বছরে (২০২১) আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে পরপারে পারি জমিছেন কিন্তু রেখে গেছেন স্বদেশ নিয়ে বিশাল কর্ম এবং ভাবনা।

এই ‘আমার স্বদেশ ভাবনা’ বইটি গত বছর উপহার পেয়েছিলাম পাঠশালা নামক একটি বিশাল ফেসবুক গ্রুপ থেকে যদিও সেখানে আমি এখন অবাঞ্চিত। যাই হউক গতকাল এক কলিগের টেবিলে বইটি দেখে হঠাৎ মনে পরে গেলো যে এই বইটিতো আমারও ছিলো কিন্তু কাজের ব্যস্ততার কারনে তখন বেশী কছিু ভাবতে পারিনি। ঘন্টাখানেক পর সেই কলিগ ভাইটি আমাকে ডেকে ঐ বইটি ফেরত দিয়ে বললো যে আমি নাকি তাকে পড়তে দিয়েছিলাম। বইটি হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা খুলে যখন পেন্সিল দিয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মার্ক করা দেখলাম তখন বিশ্বাস হলো যে এটাতো আমারই বই যা পড়েছিলাম গতবছর। বছর খানেক পর হলেও সকলের সাথে আজ বইটি থেকে কিছু শেয়ার করছি।

লেখক বইটিতে বাংলাদেশ,বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম-কথা এবং রাষ্ট্রর অস্তিত্ব টিকে থাকা নিয়ে তার অভিজ্ঞতা সকলের সাথে শেয়ার করেছেন। তিনি সতর্ক করেছেন যে, আমাদের সামান্য ভুলের জন্য এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা বিলুপ্ত হতে পারে। তিনি জাতীয়তাবাদকে দুভাগে ভাগ করেছেন যেমন আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ এবং আত্মরক্ষামূলক জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এখন হিন্দুত্বকে নির্ভর করে আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে। কাজেই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ভারতের এই আগ্রাসী জাতীয়তাবাদকে মাথায় রাখতে হবে।

বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে তাঁর কথাগুলোকে অস্বীকার করার কোন উপায় দেখছি না।

বর্তমান পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে ১৭০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। নৌপথে তা প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার। কাজেই আমার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য পাকিস্তান তেমন হুমকি স্বরুপ নয় যেমন হুমকিস্বরুপ রয়েছে প্রতিবেশী ভারত। এবং পুরো বইটিতে বাংলাদেশের আত্মরক্ষামূলক জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিকোন থেকে তার বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।

বঙ্গ ও বাংলাদেশ                   

গবেষকদের মতে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ এই সব নামগুলি নাকি এসেছে চীনা পরিবারভুক্ত ভাষা থেকে। চীনা শব্দ কিয়াং এর অর্থ হলো নদী। চীনা পরিবারভুক্ত ভাষায় য়ং ধ্বনি সাধারণত নদীর নামের সাথে যুক্ত থাকতে দেখা যায়। যেমন ইয়াংসিকিয়ং, হোয়াংহো, সাংপো, দিস্তাং (দিস্তা) প্রভৃতি। বঙ্গ সম্ভবত ছিলো একটি নদীর নাম বা জলাভূমির নাম। আর তার তীরবর্তী মানুষদের বলা হতো বাঙালি। যদিও কেউ কেউ বাংলাভাষাকে আর্য পরিবারভুক্ত ভাষা হিসেবে বর্ণনা করে। ভারতের খ্যাতনামা মহিলা নৃতাত্তিক ইরাবতী কার্ভ এর মতে বঙ্গ নামটা আর্যভাষা পরিবারের নয়।কারণ যে সব ভাষাকে সাধারণভাবে স্থঅপন করা হয় আর্য পরিবারভুক্ত ভাষায়, ক্রিয়াপদ ছাড়া তাদের ক্ষেত্রে বাক্য গঠিত হতে পারে না। কিন্তু বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদ ছাড়া বাক্য গঠিত হতে পারে। আর্য ও আর্যভাষা সম্পর্কএ সংক্ষেপে জানতে বাংলাভাষী অঞ্চলে প্রাক আর্য সভ্যতা আলোচনাটি পড়া যেতে পারে সেখানে আরো গবেষণামূলক আলোচনা করা হয়েছে।

মুসলমান নৃপতিদের শাসনামলে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ফারসি ভাষায় বলা হতো ‘বাঙ্গালাহ‘। তা থেকে দেশের নাম হলে পারে বাঙ্গালা। আমরা লিখছি বাংলা। পুর্তগিজ ভাষায় দেশটাকে বলা হতো ( Bengala  )। যা থেকে ইংরেজি ভাষায় নাম হয় ( Bengal )। বৃটিশ শাসনামলে বাংলা প্রদেশের যে অংশ ভাগীরথী নদীর পশ্চিমে পড়তো তাকে বলা হতো পশ্চিমবঙ্গ বা পশ্চিম বাংলা। পদ্মার দক্ষিণে ভাগীরথী  মধুমতি নদীর মধ্যেভাগে বাংলা প্রদেশের যে অংশ পড়ে তাকে বলা হতো মধ্যবঙ্গ বা মধ্যে বাংলা। যমুনা ও মধুমতীর পূর্বে যে অংশ, তাকে বলত পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব বাংলা। পদ্মা নদীর উত্তরে ও যমুনা নদীর পশ্চিমে বাংলা প্রদেশের অংশকে বলা হতো উত্তরবঙ্গ বা উত্তর বাংলা। পাকিস্তান হবার পর বৃটিশ আমলের বাংলা প্রদেশের যে অংশ সাবেক পাকিস্তানে পড়ে ও আসাম থেকে তদানীন্তন শ্রীহট্ট বা সিলেট জেলার যে অংশ গণভোটের মাধ্যমে আসে, তাকে একত্রে বলা হতো পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ প্রদেশ। ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাস থেকে পাকিস্তান এর পূর্ববঙ্গ প্রদেশের নামকরণ করা হয় পূর্ব-পাকিস্তান, তাই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়েছে বাংলাদেশ নামে।

বাংলা ভাষার পৃষ্টপোষক কারা?

বাংলা ভাষার চর্চা ও পৃষ্টপোষকতা শুরু হয় মূলত স্বাধীন সুলতানদের আমলে যদিও সরকারি ভাষা ছিল ফারসি। স্বাধীন সুলতান হোসেন শাহ এর আমলে তার সেনাপতি পরগল খাঁ সভাকবি পরমেশ্বরকে নির্দেশ দেন সংস্কৃত মহাভারতের বাংলা তরজমা করতে । সুলতান হোসেন শাহ এর পুত্র নসরৎ খান তার সভাকবি শ্রীকর নন্দীকে বাংলায় মহাভারতের একটি অনুবাদ করতে বলেন। শ্রীকর নন্দী মহাভারতের একটি অপেক্ষাকৃত বিস্তৃ অনুবাদ করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় সুলতানী আমলের আগের কোন বাংলা সাহিত্যের পরিচয় এখনও পাওয়া যায় নি। মুসলিম শাসনের আগে বাংলা ভাষায় লেখা কোন বই এখনও আবিস্কৃত হয়নি। সবচেয়ে পুরানো বাংলা বই এখনও যা আবিস্কৃত হয়েছে, তা হলো মুহম্মদ সগীরের লেখা ‘ইউসুফ জুলেখা’।

স্বাধীনতার ঘোষক কে?

লেখক এখানে স্পর্শকাতর বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে এনেছেন। তৎকালীন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ইন্দিরাগান্ধীর বাংলাদেশ সম্পর্কিত আলোচনা তুলে ধরছেন । যারা জানতে ইচ্ছুক তারা বইটি সংগ্রহ করে পড়তে পারেন।

টাকা শব্দটি কোথা থেকে এসেছে?

বাংলা ভাষায় ‘টাকা’ শব্দটা এসেছে তুর্কি শব্দ ‘তনখা’ থেকে। তনখা বলতে বুঝাত এক রকম রোপ্য মুদ্রাকে। সুবে বাংলার বিখ্যাত সুবেদার শায়েস্তা খার আমলে এক তখায় পাওয়া যেত আচ মন  চাল!

ছোট্ট ছোট্ট পরিচ্ছেদে লেখক ও দার্শনিক এবনে গোলাম সামাদ তুলে এনেছেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের ঘটনাগুলো। তুলে এনেছেন ৭৪ এর ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের কথা, কিসের জন্য এ অবস্থা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা। আমাদের জাতীয় সংগীতের ইতিহাস, তুলে এনেছেন আদিবাসীদের কথা, নারী-স্বাধীনতার আলোচনাতে তুলে এনেছেন বেগম রোকেয়া ও ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণীর কথা।

আমাদের সাহিত্য ও শিল্পকথার নানান কথার পাশাপাশি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন শিল্পী শেখ মোহাম্মদ সুলতান (১৯২৩-১৯৯৪) এর সাথে। শিল্পী সুলতানের অধিকাংশ কাজেই হয়েছে হয়েছে বাংলাদেশের কৃষক ও গ্রামের উপর। তাঁর ছবিতে কৃষক-কৃষানীদের চিত্র অংকিত হয়েছে বিশেষ পেশীবহুলভাবে। যারা তাদের পেশীর জোরে খেটে খায় ক্ষেতে খামারে। লেখকের মতে  তাঁর ছবিতে ধরা পড়েছে এক বিশেষ ব্যক্তি-চেতনা। ধরা পড়েছে শক্তিবাদের দর্শন। সুলতান ছিলেন শক্তিবাদের শিল্পী। তিনি এক সময় নাকি যোগ দিয়েছিলেন আল্লামা মাশরেকি প্রতিষ্ঠিত খাকছার দলে যারা বিশ্বাস করতেন শক্তিবাদে।

 এরকম নানান বিষয় নিয়ে মাত্র ১৩৫ পৃষ্ঠার বইটি পাঠ করতে কারো একঘেয়েমি লাগবে বলে মনে হয় না। অনেক পাঠকই আছেন যারা বড় বই পড়তে ক্লান্তি অনুভব করেন কিন্তু নিজের দেশকে নিয়ে ইতিহাস জানতে চান তাদের জন্য এই বইটি উপকারী হবে আশাকরি।

বইয়ের নাম: আমার স্বদেশ ভাবনা

লেখকের নাম: এবনে গোলাম সামাদ

প্রকাশনির নাম: পরিলেখ

মূদ্রণ মূল্য:২৪০.০০

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৩৫।

ক্যাটাগরিসমূহ
কবিতা

গুম করে দাও সব

এই সাংঘাতিক এদিকে আয়

আমার নামে কী রিপোর্ট করেছিস!

কোটি টাকা মাইরা খাইছি

তোর বা….র  ফুটানি গেছে নি?

িআমারে চিনোছ! এক্কেরে গুম কইরা দিমু

হাতে সুপারি দেখছোস, এক্কেরে শোয়াইয়া দিমু!

তোর আর বা…..র ভাইরা পুপ মাইরা গেছে

তেমন চুপ মাইরা থাক! টু শব্দ করবি না,

চুপ না থাকলে খুন কইরা ফালামু!

হ! ভাইজান! আমি ভীতু মানুষ, আমারে গুম কইরা ফালান

হাতের সুপারি দিয়া এক্কেরে শোয়াইয়া ফেলান।

জোচ্চোরের হাতে মইরাও শান্তনা দিতে পারমু নিজেরে

আল্লারে কমু এ আমারে খুন করছে।

মইরা গেলে আর কী হইবো? বৌ-পোলাপান কানবো

ঐ যে মনে আছে এখনও

যখন আপনাদের বড় ভাইয়েরা খুনের প্রস্তুতি নিছিলো

এমন সময় কন্যাদের ফোন! বাবার কান্না শুনে বলেছিলো

বাবা তুমি কাদঁছো কেন? যতবার ভাবি আমারও কান্না চলে আসে,

আর কান্না করতে চাই না, আমাকেও খুন করে ফেলেন!

আমার পরিবারও আমাকে হারিয়ে এমনি কাদঁবে

আর খোঁজ করে ফিরবে, বাবা কবে ফিরবে ?

কাপুরুষের মতো নিশ্চুপ থাকার চেয়ে

জোড়াল গলায় সত্য পৌঁছাতে চাইে

আজ না হয় কাল এমনিতেই মরবো

মারতে চাও ? নাও বুক পেতে দিলাম মারো!

কি! তোর এত্তো বড় সাহস

নে এখনই তোরে ওপার পাঠিয় দিচ্ছি

হঠাৎ গুলির শব্দ! ছিনেমার মতো পাখিরা উড়ে যায় নি

সবকিছু যেমন ছিলো, তেমনি আছে

শুধু পিচ ঢালা রাস্তা লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে

লাশের তর্জনি শুধু আকাশের দিকে তাক করে

হয়তো বলতে চাচ্ছে, হে আল্লাহ সাক্ষী থাকো।

নোংরা কালপ্রিটদের কোলাহল থেকে মুক্তি একটাই উপায়

সত্য বলে যাও, গুম হয়ে যাও! খুন হয়ে যাও!

যারা গুম হতে চাও সত্যিটা বলে যাও

যারা গুলি খেতে চাও, বুক মেল ধরো

চলো গুম হওয়ার সারিতে দাড়াই

প্রজন্মকে বলে যাই, সত্যের পথে ছিলাম মোরা

সত্যেরই বিজয় চাই।

তারিখ: ১৩ জুন ২০২১

ক্যাটাগরিসমূহ
ছড়া

রম্য ছড়া: বোতল টানা ছেলে

বোতল টানা সেই ছেলেটা,

দেশে ফিরেছে

খেলার মাঠে লাথি দিয়ে

স্ট্যাম্প ভেঙেছে!

বুবুর মডেল সেনা

প্রমান রেখেছে

একের পর এক

ইতিহাস গড়েছে।

সব খানেতেই মডেল

মসজিদ বা সেনা

অপেক্ষায় থাক সবাই

বাড়ছে শুধু দেনা।

তারিখ: ১২ ০৬ ২০২১